আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহত চিকিৎসা কেন্দ্র বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে দালাল চক্রের অবৈধ রক্ত বাণিজ্য জমজমাট হয়ে উঠেছে। এখানে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা ব্লাড ব্যাংকে মাদকাসক্ত, যৌণকর্মী এবং পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে দ্বিগুন দামে বিক্রি করছে কতিপয় টেকনিশিয়ান ও দালাল চক্রের সদস্যরা।

সূত্রমতে, এসব দূষিত রক্ত রোগীর শরীরে প্রবেশ করালে আরোগ্যর চেয়ে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকিই বেশি রয়েছে। সবকিছু জেনেও কমিশনের আশায় হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারী এবং নার্সরা ব্লাড ব্যাংক থেকে মুমূর্ষ রোগীর স্বজনদের রক্ত ক্রয় করতে উৎসাহিত করছেন। একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বরিশালের বাহিরেও রক্ত সরবরাহ করছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের অভিযান না থাকায় হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকটি রক্ত বেচা-কেনার দোকানে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, গাইনী বিভাগ, সার্জারী বিভাগ, প্রসূতি বিভাগসহ অন্যান্য ওয়ার্ডের সামনে রয়েছে দালাল চক্রের সদস্যরা। শেবাচিম হাসপাতালে দীর্ঘদিন থেকে গড়ে ওঠা রক্ত ব্যবসার সিন্ডিকেট চক্রের সাথে জড়িত রয়েছেন হাসপাতালের দায়িত্বরত টেকনিশিয়ান সুনিল কুমার, অশোক চন্দ্রসহ দালাল সোহেল ও আজিম। তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাসপাতালের কতিপয় অসাধু কর্মচারীদের কমিশন দিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

শেবাচিম ও সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে প্রায় সময়ই দালালদের দেখা মেলে। তাদের টার্গেট থাকে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে আসা সহজ-সরল রোগী ও তাদের স্বজনদের। যেকোন ওয়ার্ডে রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলেই কমিশনের আশায় দালালদের কাছে খবর পৌঁছে দিচ্ছেন হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারী ও নার্সরা। সূত্রমতে, কর্মচারী ও নার্সরা রোগীর স্বজনদের অবৈধ ব্লাড ব্যাংকের দালাল ও টেনিশিয়ানদের সন্ধানসহ মোবাইল নাম্বার দিয়ে থাকেন। এছাড়াও সেখান থেকে রক্ত কিনতে রোগীর স্বজনদের উৎসাহিত করা হয়। রক্ত সরবরাহকারী চিহ্নিত দালাল সোহেল সবখানে রক্ত সরবরাহ করে থাকেন।

শেবাচিম হাসপাতালে বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রক্ত কেনা-বেচার সিন্ডিকেটের মূলহোতো হাসপাতালের টেকনিশিয়ান সুনিল। তার সাথে রয়েছেন আরও কয়েকজন টেকানশিয়ান। সূত্রে আরও জানা গেছে, দালালরা মাদকাসক্ত, যৌনকর্মী এবং পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে রক্ত সংগ্রহ করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেবাচিমের এক চিকিৎসক বলেন, রক্ত নেয়ার আগে রক্তদাতার হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়ার জীবানু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু দালালরা ব্লাড ব্যাংকে এরকম কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রক্ত সংগ্রহ করছে। ফলে কেবলমাত্র রক্তের গ্রুপ এবং ক্রসম্যাচিং পরীক্ষা করেই রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো হচ্ছে এসব দূষিত রক্ত। যেকারণে রোগীর আরোগ্যের পরিবর্তে মৃত্যুঝুঁকিই বেশি থাকে। তাছাড়া রোগী নানা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

শেবাচিমে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর ভাই মোঃ সোহাগ বলেন, আমার বোনের দুই ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। অনেক কষ্টে এক ব্যাগ সংগ্রহ করেছি। বাধ্য হয়ে আর এক ব্যাগ রক্তের জন্য নার্সদের পরামর্শে দালালের মাধ্যমে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করেছি।

হাসপাতালের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দালাল সোহেল ও আজিমসহ অন্যান্যরা রোগীর আর্থিক অবস্থা বুঝে দুই থেকে চার হাজার টাকায় প্রতিব্যাগ রক্ত বিক্রি করে আসছে। মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত বিক্রি করেও দালাল সিন্ডিকেট চক্রটি রোগীদের প্রতারিত করছে। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সন্ধানী ব্লাড বাংকের কতিপয় ব্যক্তির ম্যাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করে দালাল চক্রটি বিক্রি করে আসছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শেবাচিমে রক্ত বেচা-কেনার মূলহোতা দালাল সোহেল হাসপাতালের ব্লাড বাংকের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোগীদের চাঁপ কম থাকায় ব্লাড বাংকের মধ্যে প্রবেশ করে দায়িত্বরত টেকনিশিয়ানদের সাথে হিসেব নিকেশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন দালাল সোহেল। রোগীর ভাই পরিচয়ে রক্ত কেনা-বেচার মূলরহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে।

নিজেদের নির্দোষ দাবি করে শেবাচিমের টেকনিশিয়ান সুনিল ও অশোক বলেন, রক্ত কেনা-বেচার বিষয়ে আমরা কিছুই জানিনা। স্থানীয় কয়েকজন যুবক এখানে এসে রোগীদের টাকার বিনিময় রক্ত দিচ্ছে বলে শুনেছি।

হাসপাতালের অপর একটি সূত্র জানিয়েছেন, দালাল সোহেল, মজিবরসহ ৩/৪জনকে অতিসম্প্রতি রক্ত কেনা-বেচার সময় হাসপাতালের নিচতলায় বসে ব্লাড ব্যাংক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা হাতেনাতে আটক করে গণধোলাই দেয়। ওইসময় দালালরা হাসপাতালে আর কোনদিন রক্ত কেনা-বেচা করবেনা বলে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায়। এ ঘটনার কয়েকদিন পরেই গণধোলাইর শিকার দালাল চক্রের সদস্যরা পূর্ণরায় তাদের রক্ত কেনা-বেচার কার্যক্রম শুরু করেছে।

এ ব্যাপারে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মোঃ বাকির হোসেন বলেন, হাসপাতালে দালালদের ধরার জন্য আমাদের প্রশাসনিক অভিযান চলছে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের কোন কর্মচারী রক্ত কেনা-বেচার দালালদের সাথে জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(টিবি/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮)