সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি : সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়া পৌর শহরের ঝিকিড়া মধ্যেপাড়া মহল্লার জেনাত আলী প্রামানিক (৭৫) ও তার স্ত্রী লিলি খাতুন (৫৭) এর আবাস্থল এখন নর্দমা ভর্তি পুকুরে। জীবন যৌবন নিঃশেষ করে শ্রমবিক্রির মাধ্যমে মানুষ করেছেন পাঁচ সন্তান। শ্রমজীবি বাবার পরম মমতা ভালবাসায় বড় হয়ে তারা আজ কর্মজীবি। স্ত্রী সন্তান নিয়ে গড়েছেন সুখের সংসার। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়েরা বড় হলে তার দুঃখের জীবনের অবসান ঘটবে।

কিন্তু বিধি তার কপালে সেই স্বপ্নের সুখ মেলাইনি। জীবনের শেষ সম্বল মাথা গোজার ঠাই বসত বাড়ি জোর পূর্বক লিখে নিয়েছে বড় সন্তান। বাড়ি লিখে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সে। সেই বাড়ি থেকে নির্যাতন করে বের করে দিয়েছে ছেলের স্ত্রী। সম্পদ না থাকায় অন্য ছেলে মেয়েরাও তার খোঁজ খবর নেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে অসুস্থ

শরীরে বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে অন্যের বাড়ির নর্দমা ভর্তি পুকুরে চকি পেতে ভাঙ্গা টিন আর পলিথিন টানিয়ে ঘর বানিয়ে সেখানে খেয়ে না খেয়ে পার হচ্ছে দিন। ব্রেইন ষ্টোক ও প্যারালাইসড হয়ে শয্যাসায়ী হলেও মিলছে না কোন চিকিৎসা সেবা। নিজ ছেলে-মেয়েদের দ্বারা বৃদ্ধ বাবা মায়ের এমন করুন পরিনতি। এক সময় এই বৃদ্ধা উল্লাপাড়া পাটবন্দর কুলি শ্রমিকের সর্দার ছিলেন।

জানা যায়, উল্লাপাড়া পাটবন্দরের কুলি সর্দার জেনাত আলী শ্রমজীবির কাজ করে অনেক কষ্টে তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে বড় করেন। তারা সবাই বিয়ে করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সংসার গড়েছেন। ভালই চলছিল জেনাত আলীর সংসার। ৬/৭ বছর আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সুযোগে তার বড় ছেলে আব্দুল খালেক কৌশলে বাবার একমাত্র সম্বল পৌনে তিন শতক বসত বাড়ি লিখে নেয়। পরে বিষয়টি স্থানীয় ভাবে জানাজানি হলে সংসারে অন্য ছেলে মেয়েরা তা নিয়ে অশান্তি শুরু করে।

গ্রাম্য সালিশ থেকে বিষয়টি মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। জেনাত আলী অন্য ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীর পরামর্শে বড় ছেলের নামে সম্পত্তি লিখে নেয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করে। এ নিয়ে বাবা ছেলে মধ্যে শুরু হয় গৃহ বিবাদ। এক পর্যায়ে বাবা মাকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ছেলে আব্দুল খালেক ও তার স্ত্রী। বাবার আর সম্পদ না থাকায় অন্য দুই ছেলে ও মেয়েরাও এ সময় বৃদ্ধ বাবা-মাকে তাদের কাছে স্থান দেয়নি।

তাই বাধ্য হয়ে জেনাত আলী প্রতিবেশী আব্দুল কুদ্দুসের নর্দমা ভর্তি পুকুরের পাশে স্থান নেন। সেখানে ভাঙ্গা টিন আর পলিথিন টানিয়ে বৃদ্ধ স্বামী- স্ত্রী মাথা গোজার ঠাই গড়ে তোলেন। ছেলে মেয়েরা ভরণপোষন না করায় শারীরিক অসুস্থ্যতায় তিনি মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন।

জেনাত আলীর এমন হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি দেখে পাটবন্দর শ্রমিকরা মিলে সাপ্তাহিক কিছু অর্থ সহায়তা করছেন। তাই দিয়েই কোন রকম খেয়ে না খেয়ে কাটছে তাদের দিন।

রবিবার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরের দিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা মেলে এমন দৃশ্য। নর্দমা ভর্তি পুকুরে বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে। তার এক পাশে কোন রকম ভাঙ্গা টিন আর পলিথিন টানিয়ে একটি ঝুপড়ি ঘর।

তার মধ্যে চকি পেতে কোন রকম একটা সাদা ছোট কাপড় পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে আছে অসুস্থ জেনাত আলী। তার স্ত্রী লিলি খাতুন সেই ঘরে নোংড়া হাটু পানির মধ্যে ভেসে থাকা মাটির পাত্র থেকে পড়নের কাপড় বের করছেন। ঘরের ভিতর মসা-মাছি আর দূর্গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অসুস্থ জেনাত আলী তখনও ঘুমে বিভোর। বাহিরে অপরিচিত লোক দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন তাঁর স্ত্রী লিলি খাতুন। কাছে ডেকে এমন স্থানে কেন বসবাস জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

কান্না কন্ঠে জানালেন, আমার স্বামীর নিজস্ব সম্পত্তি আর নেই বাবা তাই এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি। আমার স্বামীর একমাত্র অবলম্বন ছিল বাড়িটি কিন্তু আমার বড় সন্তান আব্দুল খালেক ফাঁকি দিয়ে লিখে নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তার বিরুদ্ধে প্রথমে স্থানীয় ভাবে অভিযোগ করলেও কোন বিচার না পেয়ে বাড়ি ফেরত চেয়ে মামলা করেন তার স্বামী। তাই ছেলে ও তার বউ তাদের ঘর ও বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। যাবার কোন স্থান না পেয়ে তারা এখানে কোন রকমে আশ্রয় নিয়েছি। বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে হাটু পানি হয় তবুও থাকি।

স্থানীয়রা বলছেন,পাট বন্দরের শ্রমিকদের দেয়া কিছু আর্থিক সহযোগীতা পেয়ে তারা ঔষধ আর মানুষের দেয়া খাবার খেয়ে বেচে আছেন। সাংবাদিক এসেছে এমন খবর শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে জেনাত আলীর বড় ছেলের স্ত্রী রেশমা আক্তার। সাংবাদিকদের কাছে ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শুনে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েন।

তিনি দাবী করেন, শ্বশুড় তার স্বামীর কাছে ওই বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র জায়গা কিনেছেন। অন্য ছেলে মেয়েদের পরামর্শে তার স্বামীর নামে শ্বশুড় মিথ্যা মামলা দিয়েছে। তিনি তাদের ভরন পোষন করতে চাইলেও তারা তা গ্রহণ করে না। অপরদিকে স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলছেন, জেনাত আলীর অন্য দুই ছেলেও কর্মজীবি। মেয়েদের বাড়িও পাশেই। তারা নিজেরা পাকা ঘর বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করলেও বৃদ্ধা বাবা মায়ের আশ্রয় হয়েছে নর্দমার পুকুরে।

মাঝে মাঝে তারা গিয়ে তাদের দেখে আসলেও সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে নিজেদের বাড়িতে স্থান দিচ্ছে না। স্থানীয় প্রতিবেশীরা যা দেয় তাই খেয়ে বেঁচে আছেন। জেনাত আলীকে আশ্রয় দেয়া জায়গার মালিক আব্দুল কুদ্দুস জানান, ছেলে মেয়েরা বৃদ্ধ বাবা মাকে আশ্রয় দেয়নি। বৃদ্ধ দম্পতির আকতি দেখে নিজের সমস্যা হলেও তিনি তাদের সেখানে থাকতে দিয়েছেন। তাদের কষ্টের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনিও কেঁদে ফেলেন।

এব্যাপারে উল্লাপাড়া পৌরসভার মেয়র এসএম নজরুল ইসলাম এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জেনাত আলীর অভিযোগটি আমলে নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মিমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি । জেনাত আলীর ছেলের বউ ও স্ত্রীর মতভেদের কারণে বিষয়টি মিমাংসা হয়নি। তারা যে এভাবে মানবতার জীবন যাপন করছে তা তিনি জানেন না। তবে এর আগে তিনি তাদের আর্থিক ভাবে সহায়তা করেছেন বলে দাবী করেন। তিনি বিশেষ প্রয়োজনে ঢাকায় অবস্থান করছেন তবে খুব দ্রুত এলাকায় ফিরে বিষয়টি স্থানীয় ভাবে সমাধান করবেন বলে জানান।

(এমএএম/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮)