সঞ্জিব দাস, গলাচিপা (পটুয়াখালী) : পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার দক্ষিণ বলইবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি ক্লাশের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে হয় একই সঙ্গে। কারণ, গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে এ বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছয়টি ক্লাশে ১১১ জন শিক্ষার্থীর দুই দফায় (শিফট) ক্লাশ নিতে হচ্ছে ওই একজন শিক্ষককে। এতে মান সম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। 

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, শিক্ষক সঙ্কট এ বিদ্যালয়ের জন্য নিয়মিত একটি সমস্যা। উপজেলা সদর থেকে তুলনামূলক দুর্গম এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় কোন শিক্ষকই এখানে বেশিদিন থাকেন না। এ কারণে শিশুদের পড়াশোনা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় এলাকার অভিভাবকদের।

গত বৃহস্পতিবার ৬ সেপ্টেম্বর সকালে দক্ষিণ বলইবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের শিক্ষক উত্তম চন্দ্র ম-ল বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৪৮ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করছেন।

দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল বলে, ‘এভাবে সবাইকে এক জায়গায় বসিয়ে ক্লাশ করলে পড়া বুঝতে কষ্ট হয়।

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইসরাত জাহানের মা ইয়ানুর বেগম বলেন, ‘স্কুলে শিক্ষক নাই তাই মেয়ের পড়াশোনার অনেক ঘাটতি হচ্ছে। অন্য স্কুলেও দেওয়া সম্ভব না। গত ১০ মাস ধরে শুনছি নতুন শিক্ষক আসবেন। কিন্তু কোন শিক্ষক আসেননি। মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে আমরা চিন্তিত।

বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সদস্য মো. নিজাম পাহলান বলেন, ‘গলাচিপা, কলাপাড়া ও বরগুনার আমতলী এ তিন উপজেলার সীমান্ত এলাকায় গোলখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ বলাইবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। তিনটি উপজেলা সদর থেকেই এ বিদ্যালয়ে যাতায়াত তুলনামূলক দুর্গম। তাই এখানে কোন শিক্ষক আসতে চান না। শিক্ষক সঙ্কটের বিষয়টি আমরা একাধিকবার কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু সমাধান হয়নি।

১৯৪৮ সালে ওই গ্রামের আব্দুল জব্বার পহলান এক একর জায়গা বিদ্যালয়ের জন্য দান করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ০.সুনামের সাথেই চলে আসছিল। কিন্তু গত চার বছর ধরে শিক্ষক সঙ্কট দেখা দেয়। চারজন শিক্ষক থাকলেও একজন বদলীজনিত কারণে অন্য বিদ্যালয় চলে যান। এর কিছুদিন পরেই ওই বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মো. ইসমাইল হোসেন অবসরে গেলে সঙ্কট আরো তীব্র হতে থাকে। জটিলতা তৈরি হয় প্রধান শিক্ষক মো. কামাল হোসেনের মৃত্যুর পর। প্রাক প্রাথমিকের একমাত্র শিক্ষক উত্তম চন্দ্রই শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন বিদ্যালয়টিতে। একজন শিক্ষক দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। উত্তম চন্দ্র কখনো বিদ্যালয়ে পাঠদান করেন। আবার কখনো দাপ্তরিক কাজ করতে উপজেলা সদরে অফিসে আসেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতা দেখে এলাকার অভিভাবকরা মাঝে মধ্যেই ক্লাশ নিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের।

দক্ষিণ বলাইবুনিয়া গ্রামের শারমিন আক্তার এবছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। ছোট ভাই জিয়ামকে নিয়ে প্রতিদিনই বিদ্যালয় যেতে হয় তার। শিক্ষক স্বল্পতার করুণ অবস্থা দেখে প্রায় একবছর ধরে নিজেই এগিয়ে এসেছেন ক্লাশ নিতে।

শারমিন বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে নিয়ে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে আসতাম। উত্তর স্যার সকল শিশুকে এক সঙ্গে পাঠদান করাতে পারতেন না। আমি ক্লাশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি রাজি হয়ে যান। সেই থেকেই ক্লাশ নিচ্ছি। মাঝে মধ্যে দু’একদিন বাদে প্রতিদিনই ক্লাশ করছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি তো এ গ্রামেরই মেয়ে। এসকল শিশুরাও আমার গ্রামের। আমরা যদি এগিয়ে না আসি তাহলে তো বিদ্যালয়টি শেষ হয়ে যাবে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক উত্তম চন্দ্র ম-ল জানান, তিনি গলাচিপা পৌরসভা সদর থেকে বিদ্যালয়ে আাসেন। শিক্ষার্থীদের পাঠদান ছাড়াও সব রকমের দাপ্তরিক কাজও তাঁকে করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় একই ইউনিয়নের অপর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষককে ওই বিদ্যালয়ে পাঠদান করার জন্য নির্দেশ দেওয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যাল থেকে। কিন্তু তাঁরাও এখন আর আসছেন না।

বলইবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্কটের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না তা জানতে চাইলে গলাচিপা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্কটজনিত সমস্যাটি আমাদের জানা আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রাথমকি বিদ্যালয়গুলোতে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দক্ষিণ বলইবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাম্য সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করবো।’

(এসডি/এসপি/সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮)