রূপক মুখার্জি, নড়াইল : চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রকাশ্যে খুন হন দিঘলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কুমড়ী গ্রামের শেখ লতিফুর রহমান পলাশ।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে চলা একটি বৈঠকের মাঝে চেয়ারম্যান পলাশ সঙ্গী আরেক ইউপি সদস্যকে নিয়ে উপজেলা পরিষদের বাইরে আসার পথে ভূমি অফিস এবং নির্বাচন অফিসোর মাঝের রাস্তায় এই হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়। ওৎ পেতে থাকা খুনীরা গুলি করে এবং কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। দিনে দুপরে প্রকাশ্যে এলাকার প্রভাবশালী চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক খুন হওয়ায় স্থম্ভিত হয়ে যায় এলাকার মানুষ।

ঘটনার তিন দিন পরে নিহত পলাশের বড় ভাই সাইফুর রহমান হিলু বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে পেনাল কোড-৩০২ধারায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২৫। মামলায় প্রধান আসামী করা হয় একই এলাকার স্থানীয় প্রতিপক্ষ নড়াইল জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক শরীফ মনিরুজ্জামান কে। মামলার অন্য আসামীরা হলেন মনিরুজ্জামানের আপন ভাই শরীফ বাকি বিল্লাহ,সোহেল খান, ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী(নৌকা)মাসুদুর রহমান, দিঘলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ওহিদুর সরদার, প্রতিপক্ষ খায়ের শেখ ,তার দুই ভাই বাবু শেখ ও রওশন শেখ, বনি শেখ ও তার ভাই কোন্টে শেখ, সৈয়দ হেদায়েত আলী,নজরুল ফকির,রিপন শেখ,আব্দুর রব মোল্যা ও দিঘলিয়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাসুম খান।

১৭ ফেব্রুয়ারি মামলার প্রধান আসামী শরীফ মুনিরুজ্জামানকে ঢাকা অবস্থানকালীন গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর মামলার অন্য ১০ জন আসামি ১৫ মার্চ তারিখে আদালতে হাজির হলে আদালত তাদেরকে জেল হাজতে প্রেরন করে। বাকি ৪ আসামী বর্তমানে পলাতক আছেন।

মামলার এজাহারে নাম থাকা আসামীদের কয়েক দফা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে কোন তথ্য বের করতে পারেনি পুলিশ। নড়াইলের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) মেহেদী হাসান এর নেতৃত্বে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার বিভিন্ন সূত্র ধরে এগুতে থাকে। কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির মোবাইল ফোন অনুসন্ধান করে পলাশ খুনের মূল আসামীদের ধরতে পুলিশী তৎপরতায় ২২ মার্চ চট্রগ্রামের বহদ্দার হাট থেকে গোলাম কিবরিয়া,২৩ মার্চ নারয়নগঞ্জ এর ফতুল্লা থেকে সৈয়দ রোমান আলী এবং ঢাকার তেজগাও বেগুনবাড়ি থেকে সৈয়দ আল-আমীনকে আটক করে। পলাশ খুনের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আসামীরা প্রত্যেকেই ১৬৪ ধারায় ম্যাজিষ্ট্রেট এর কাছে জবানবন্দী দেয়।

আল-আমিন তার জবানবন্দীতে স্বীকার করে যে,৩ বছর আগে নিহত চেয়ারম্যান পলাশ নিজ হাতে তার বাবাকে খুন করেছে,তাই সেই খুনের প্রতিশোধ নিয়েছে। এই খুনের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করে তার আপন ভাগ্নে শান্ত।

গোলাম কিবরিয়ার লিখিত জবানবন্দীতে জানায়, শান্ত’র কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে পলাশকে গুলি করে,প্রথম গুলিটি চেয়ারম্যানের গায়ে লাগলেও পরের গুলিটি সঙ্গী আল-আমিনের হাতের আঙ্গুলে লাগে বলে স্বীকার করে,এবং ওদের কাছ থেকে টাকা পাবে এই আশায় সে পলাশ খুনের অভিযানে অংশ নেয়। পুলিশের কাছে জবানবন্দী দেয়া অপরজন সৈয়দ রোমান আলী তার জবানবন্দীতে জানায়, ২০১৬ সালের নির্বাচনের পরে পলাশ চেয়ারম্যানের লোকেরা তাদের বাড়ি থেকে ৫টি গরু লুট করে নিয়ে যায় এবং তার বাবাকে দুই দফা মারধোর করে। চেয়ারম্যান পলাশের ভয়ে সে গত ৩ বছর বাড়িতে থাকতে পারে না। গত বছর কুমড়ীতে গেলে তারা তাকে মারধোর করে। নিজের পরিবারের অপমান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে এই খুনে অংশ নেয়। এই সকল খুনীদের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসা অস্ত্র সরবরাহকারী ও অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেরিন পুলিশ। শান্তকে আটক করতে পারিনি।

নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া ইউনিয়নের দাঙ্গাপ্রবন কুমড়ী গ্রামে, কথা হয় নিহত চেয়ারম্যান পলাশের পরিবারের লোকদের সাথে। প্রিয় ছেলেকে হারিয়ে পলাশের বৃদ্ধা মায়ের বিলাপ,আমার ছেলে কার এমন ক্ষতি করেছে, যে তাকে এভাবে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দিল, এখন আমার খোজ কে নেবে। নিহত পলাশের স্ত্রী বর্তমান দিঘলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নীনা ইয়াসমীন জানান,আমার স্বামীকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে,আমরা প্রকৃত খুনীদের বিচার চাই।

পলাশ হত্যা মামলার এজাহারে থাকা ৪ নং আসামী হয়ে আড়াই মাস হাজত খেটে ১৬ মে জামিনে বের হন মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, আমি গ্রামের অবস্থা বুঝতে পেরে গত ৪০ বছর আগে গ্রাম ছেড়ে লক্ষীপাশা শহরে এসে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি,তবুও পলাশ হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেলাম না। আমার অপরাধ হলো আমি ইউপি নির্বাচনে পলাশের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করেছি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে জেলার সবচেয়ে দাঙ্গাপ্রবন কুমড়ী গ্রামের ৩টি পাড়ায় খুন হয়েছেন অন্ততঃ ২৮ জন,যাদের মধ্যে ২৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে।

কুমড়ী-পশ্চিমপাড়ায় খুন হন ৬ জন। আ.রশীদ শেখ এর ছেলে বনিরুল শেখ(ছাত্র), মোসলেম সিকদার এর ছেলে বজলার শিকদার(কৃষক), গোলাম রসুল এর ছেলে ছাপা শেখ(ছাত্র).ফজর শেখ এর ছেলে মিকাঈল শেখ(কৃষক), সৈয়দ সাহেব আলী এর ছেলে ইলিয়াস আলী মীর(কৃষক) গোলাম রসুল এর ছেলে লতিফুর রহমান পলাশ(ইউপি চেয়ারম্যান)।

কুমড়ী-মধ্যপাড়া য় খুন হওয়া ৬ জন হলেন দুদু খা, দুদু খা এর ছেলে লায়েক খা, লালমিয়া শেখ এর ছেলে মুজিবর শেখ, গনি মোল্যা’র ছেলে কাতেব মোল্যা, রওশন খা এর ছেলে তোতা খা ও পাচু শেখ এর ছেলে বাদশা শেখ।

কুমড়ী-পূর্বপাড়া’য় সর্বাধিক ১১ জন খুন হন,যার দু জন আবার স্বাধীনতার আগে পাকিস্থান আমলে। খুন হওয়া এসব লোকদের পরিচয় হলো-দবির শেখ এর ছেলে ছবেদ শেখ(ছাত্র ), মতলেব শেখ এর ছেলে ঠান্ডা শেখ (কৃষক ), আতিয়ার শেখের স্ত্রী পাচি বিবি, ওজেত শেখ এর স্ত্রী অলেকা বিবি, ধলা মিয়ার মেয়ে ভিক্ষুক আমেনা(গুঙ্গি), খালেক শেখ এর ছেলে আফসার শেখ (কৃষক ), রোকন শেখ এর ছেলে কালা শেখ (কৃষক ),বাচ্চু শেখ এর ছেলে তরিকুল শেখ(কৃষক) ,কাউসার ফকির এর ছেলে তনু ফকির(যুবক), রউফ শেখ এর ছেলে শিশু আজিজুর শেখ ও মুকুল শেখ এর শিশু ছেলে সিয়াম।

নড়াইল জেলার সবচেয়ে দাঙ্গাপ্রবন দিঘলিয়া ইউনিয়নের কুমড়ী গ্রাম। তথ্য বলছে কেবলমাত্র এই একটি গ্রাম থেকে গত ৫০ বছরে খুন হয়েছেন অন্ততঃ ২৮ জন। যার বেশিরভাগই প্রতিহিংসামূলক। আবার একটি খুন হলে আধিপত্য বিস্তার করতে আসামী করা হয় প্রতিপক্ষকে। বছরের পর বছর ধরে চলা এসব খুনের ঘটনা এবং পাল্টা হামলা,ভাংচুর আর লুটপাটের কারনে মামলা হয়েছে প্রায় ৩০ টি,আসামী অন্ততঃ ৩ হাজার জন। বছরের পর বছর ধরে চলা গ্রাম্য কোন্দলের কারনে মামলার কারনে নিশ্ব হয়েছেন অনেকে,অনেকে আবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। হত্যা আর লুটপাটের আতঙ্কে ভূক্তভোগীরা।

কুমড়ী গ্রামের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ওসমান সর্দার বলেন,এই গ্রামের যত খুন হয় কিছুদিন পর তা মিটমাটের জন্য একদল লোক উঠে পড়ে লেগে যায়, এখানকার প্রভাবশালী লোকদের জন্যই কোন হত্যা মামলার সঠিক বিচার না হওয়ায় এলাকায় খুন থামছে না।

মামলার বাদী নিহত পলাশের বড়ভাই,নড়াইল জেলা পরিষদের সদস্য সাইফুর রহমান হিলু বলেন,পুলিশ ঘটনা ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতেই এজাহার ভূক্ত আসামিদের বাদ দিয়ে অন্যদের জবানবন্দী নিয়েছে। ঘটনাটি পুলিশের সাজানো। মামলার এজারহারভূক্ত আসামীরা এখনও কয়েকজন এলাকা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ পুলিশ তাদের ধরছে না।

মামলার প্রধান আসামী কুমড়ী গ্রামের সালাম শরীফের ছেলে শরীফ মনিরুজ্জামান। নড়াইল জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক। ঢাকার এই ব্যবসায়ী সংসদ নির্বাচনের জন্য এলাকায় আসা যাওয়া শুরু করেছিলেন। পলাশ হত্যা মামলার প্রধান আসামী হয়ে ইতিমধ্যে হাজত খেটেছেন প্রায় ৬ মাস।বর্তমানে জামিনে মুক্ত।

তিনি বলেন, আমাদের স্থানীয় এমপি শেখ হাফিজুর রহমানের চক্রান্তে আমাকে আসামী করা হয়েছে। আমি এমপি নির্বাচন করতে মাঠে আসি এটা ওনার সহ্য হচ্ছে না। তিনিই এলাকার সব হত্যা মামলা মিমাংশা এবং জড়ানোর ব্যাপারে বড় ভূমিকা রাখেন।

আসামীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে নড়াইল-০২ আসনের সংসদ সদস্য কমড়ী গ্রামের বাসিন্দা এড.শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, মনিরুজ্জামানের মতো অনেকেই এমপি প্রার্থী হিসেবে দৌড়ঝাপ করছে,সবাইকে মামলা দিয়ে আটকানো হয়নি। আসামী মনির শরীফ কালো টাকার মালিক হয়ে এলাকায় টাকা ছড়িয়েছে, সে মনে করেছে এলাকায় পলাশ থাকলে সুবিধা হবে না, তাই টাকা দিয়ে পলাশ কে হত্যা করিয়েছে। এলাকার হত্যা মামলার বিচার না হওয়া প্রসঙ্গে এই আইনজীবি বলেন,মামলার মিমাংশা তো হতেই পারে, তাতো আইনে নিষিদ্ধ নাই।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা লোহাগড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম বলেন, অধিকতর তদন্ত শেষে চাঞ্চল্যকর পলাশ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দেয়া হবে।

পলাশ হত্যা মামলায় বিশেষ ভূমিকা রাখা নড়াইলের সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী হাসান বলেন, এলাকায় হত্যা হলেই প্রতিপক্ষকে আসামী করা হয়। পলাশ হত্যা ঘটনার প্রকৃত রহস্য বের হরতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। অস্ত্র সরবরাহকারী শান্তকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। অচিরেই পুলিশ এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার চার্জশীট দাখিল করবে।

এ ব্যাপারে নড়াইলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন পিপিএম বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান পলাশ হত্যা মামলাটি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃত তিনজন পলাশকে হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্ধী দিয়েছে। পুলিশ সঠিক পথেই এগুচ্ছে।

খুনোখুনি আর প্রতিহিংসা টিকিয়ে রেখেছে গ্রাম্য কোন্দল। যার সুফল ভোগ করেন মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট আইনজীবি,পুলিশের লোক আর ক্ষমতালোভী মাতবরেরা। সাধারন মানুষ প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচার করে এসব নোংরা গ্রাম্য রাজনীতি থেকে মুক্তি চায়, পরিত্রাণ চায়।

(আরএম/এসপি/সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮)