কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : কুষ্টিয়ার ৭ থানায় গত ২৫ দিনে বিএনপি নেতা-কর্মিদের নামে ২৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে এর মধ্যে এজাহার নামীয় ৭৯৮জন। আর অসংখ্য অজ্ঞাত আসামী। প্রতিটি মামলায় নাশকতার। এর মধ্যে বেশির ভাগ বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। নাশকতার এসব মামলায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা, মৃত ব্যক্তি, প্রবাসী ও কারাগারে বন্দি আছেন এমন লোকজনকেও আসামী করেছে পুলিশ। 

এর বাইরে আওয়ামীলীগ করা সাধারন মানুষকেও আসামী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অন্তত ২০০ ব্যক্তিকে এসব মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘গত ২৫ দিনে আমাদের দলের নেতা-কর্মিসহ সাধারন মানুষের নামে পুলিশ ২৫টি মামলা দিয়েছে। আমার নির্বাচনী এলাকা সদর থেকে আটক করা হয়েছে ৯৫ জনকে। বিশেষ করে ইবি থানায় যেসব মামলা দেয়া হয়েছে তারা সবাই নিরীহ। থানার ওসিসহ অন্যরা আওয়ামী লীগ নেতাদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী বেছে বেছে মামলা দিচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই নিরীহ ও সাধারন মানুষ। নির্বাচনকে বানচাল করতে পুলিশ মাঠে নেমেছে।

তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিরাও মামলা থেকে রেহায় পাচ্ছে না। আর বাড়ি থেকে ধরে এনে বোমা ও অস্ত্রসহ আদালতে পাঠানো হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৫ দিনে ৭ থানায় ২৫টি মামলা রজু হয়েছে। এর মধ্যে ইবি থানায় ৬টি, সদরে ৪টি, মিরপুরে ৩টি, দৌলতপুরে ৩টি, কুমারখালী ৫টি, খোকসা ২টি ও ভেড়ামারায় ২টি। মামলার অধিকাংশ স্বাক্ষী করা হয়েছে আওয়ামীলীগ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাদের।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশ কাল্পনিক সব মামলা দিচ্ছে। মামলায় মৃত ব্যক্তিকে আসামী করা হয়েছে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিনারায়নপুর ইউনিয়নের পদ্মনগর গ্রামের মৃত আমোদ আলীর ছেলে আরব আলী মারা যান ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর মাসে। তিনি পদ্মনগর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ছিলেন। গত ২২ সেপ্টেম্বর ইবি থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। মামলায় এজাহার নামীয় আসামীর সংখ্যা ৪৯জন। আরব আলী এ মামলায় তিন নম্বর আসামী। ১ ও ২ নম্বর আসামীর জবানবন্দি থেকে আরব আলীকে ৩ নম্বর আসামী করা হয়। তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।

পদ্মনগর ওয়ার্ডের মেম্বার ও আওয়ামীলীগ নেতা মিজান উদ্দিন বলেন, ভাই পুলিশ আমাদের কাছে নাম চেয়েছিল, আমরা অনেকের নাম নাম দিয়েছিলাম। তবে আরব আলীতো এক বছর আগে মারা গেছে। তার নামতো দেয়া হয়নি। আরব আলীকে পুলিশ ভুল করে আসামী করেছে।

আরব আলীর ছেলে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমার বাবা আগে সিআইডিতে কর্মরত ছিল। অবসরে যায় ২০০৩ সালে। পরে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত হয়। সে প্রায় এক বছর আগে মারা গেছে। শুনেছি তাকেও আসামী করা হয়েছে। মামলা থেকে আওয়ামী লীগ নেতারাও রক্ষা পাননি। মৃত আরব আলী যে মামলায় আসামী সেই একই মামলায় হরিনারায়নপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মহিউদ্দিনকে আসামী করা হয়েছে। তার পিতার নাম মৃত কওসের আলী। সেও পেট্রোল বোমা নিয়ে গোপন মিটিং করছিল বলে দেখানো হয়েছে।

মহিউদ্দিন বলেন, পুলিশ যে মামলা দিয়েছে তাতে আমাকেও আসামী করা হয়েছে। মামলায় আমার ও আমার বাবার নাম ঠিকই দেয়া আছে। পুলিশ কেন আমার নামে মামলা দিল তা বুঝতে পারছি না। হয়তো ভুল করে দিয়েছে।

ইবি থানার মামলায় আব্দালপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি ইফসুফ আলী ও তার ভাই লাল্টুকে আসামী করা হয়েছে। লাল্টু চলতি মাসের ৬ সেপ্টেম্বর ইয়েমেনে গেছেন। তাকেও ইবি থানার মামলায় পুলিশ আসামী করেছে।

ইউসুফ আলী বলেন, আমার ভাই এ মাসে ইয়েমেন গেছে। তার সব কাগজপত্র আছে। আর আমি কলেজে চাকুরি করি। ওই দিন পরীক্ষার হলে ডিউটিতে ছিলাম। আমার হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরও আছে। পুলিশ মিথ্যা মামলা দিয়েছে।

তিনি বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ নেতাদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী মামলা করছে পুলিশ।

সম্প্রতি আব্দালপুর ইউনিয়নের ফরহাদসহ তার অনুগতরা আওয়ামীলীগে যোগদান করে। পুলিশ তাদেরও মামলায় আসামী করেছে।

পুলিশের ওয়াচার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আগের তালিকা দেখে নাম দেয়া হয়েছে। হয়তো ভুল হতে পারে।’
দৌলতপুর উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি রেজাউল করিম রেজা। গত ২০ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানার নাশকতা মামলার ১৮ নং আসামি হয়েছেন এই নেতা। যার মামলা নম্বার-৪১। অথচ ওই সময় তিনি ভারতে একটি জটিল অপারেশন করে বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন।

ভেড়ামারা পৌর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। ৩১ আগস্ট ভেড়ামারা থানার নাশকতার মামলার আসামির রয়েছেন তিনি। অথচ ওই সময় তিনি হজ্ব পালনে সৌদি আরব ছিলেন।

দৌলতপুর থানার একটি মামলায় ইয়াকুব নামে এক ব্যক্তি মালয়েশিয়ায় আছে। তাকে নাশকতার মামলায় আসামী করা হয়েছে।

দৌলতপুর থানার বিএনপির সভাপতি রেজা আহমেদ বাচ্চু বলেন, ‘পুলিশ ভৌতিক সব মামলা দিচ্ছে। যার কোন সত্যতা নেই। আমার দলের দুই কর্মি জাপান ও শিপন জেলে আছে। তাদেরও আসামী করেছে পুলিশ। এছাড়া ইয়াকুব দেশের বাইরে থাকে, সেও রক্ষা পায়নি মামলা থেকে।

তিনি বলেন, দিনে গড়ে ১টি করে মামলা দিচ্ছে পুলিশ। মামলায় যাদের আসামী করা হচ্ছে তারা নিরীহ। বোমা তো দুরে থাক কোনদিন পটকাও দেখেনি।

মিরপুর উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক রহমত আলী রব্বান বলেন, ‘মিরপুর থানায় আমি ও আমার ভাইয়ের নামে পুলিশ নাশকতার একটি মামলা দিয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর মামলাটি হয়। মামলায় আমাকে ৬ নম্বর ও ভাইকে ৮নম্বর আসামী দেখানো হয়েছে। মামলার আসামী আমার ভাই ইব্রাহীম মালিথা তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে গত দুই সপ্তাহ ভারতের ভেলোরে অবস্থান করছে।

ইবি থানার অফিসার ইনচার্জ রতন শেখ মৃত ব্যক্তিকে আসামী করার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ধৃত ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী মামলা হয়েছে। যাচাই করার সময় পাওয়া যায়নি।’

কারাগারে আটক দুইজনের ব্যাপারে দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ শাহ দারা খান বলেন, ‘অনেক সময় যাচাই বাছাই করার সময় থাকে না। তবে মামলার বাদী (এসআই সোহেল রানা) কিভাবে এই দুইজনের নাম দিলেন তা খতিয়ে দেখা হবে।’

কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, নাশকতার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সময় বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছিল। তাদের স্বীকারোক্তিতে এজাহারে অনেকের নাম এসেছে। যদি এধরণের কোন ব্যক্তির নাম এজাহারে থাকে তাহলে তদন্তে তাদের নাম বাদ দেয়া হবে।

(কেকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৮)