স্পোর্টস ডেস্ক : টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক আগে পেয়েছিলন দুঃসংবাদ, চিড় ধরা পড়ে বুকের পাঁজরের নয় নম্বর হাড়ে। আশঙ্কা দেখা দেখিয়েছিল দেশে ফিরে আসার। বেশ চিন্তাভাবনা করে, টিম ম্যানেজম্যান্ট ও ফিজিওর সাথে বিস্তর আলোচনা করে থেকে যান দুবাইতে। তার এই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কারণেই এখনো এশিয়া কাপে টিকে রয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।

বলা হচ্ছে মুশফিকুর রহিমের কথা। আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে মাঠে নামার টের পাওয়া চোটের কারণে যে সংশয় দেখা দিয়েছিল মুশফিকের খেলা নিয়ে, সেটি নিজের ব্যাটেই দূর করেছেন বাংলাদেশ দলের উইকেটরক্ষক এ ব্যাটসম্যান। পাঁজরের ব্যথার কারণে প্রতিটি ম্যাচেই খেলছেন বুকে টেপ পেঁচিয়ে, দলকে উদ্ধার করছেন কঠিন বিপদ থেকে।

চলতি এশিয়া কাপে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের খেলা ৫ ম্যাচের মধ্যে ৪টিতে ছিলেন মুশফিক। বিশ্রামে ছিলেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটিতে। সে ম্যাচে বিব্রতকর হারে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে একাদশে ফেরেন মুশফিক, কিন্তু হাসেনি তার ব্যাট। আউট হন ২১ রান করে, জিততেও পারেনি বাংলাদেশ দল।ন

টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের হেরে যাওয়া ম্যাচ এ দুটিই। দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবালের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, তামিমের ব্যাট হাসলে, হাসে বাংলাদেশ। কিন্তু এবারের এশিয়া কাপে শুরুর ম্যাচ থেকেই ছিটকে যান তামিম। ফলে শূন্যতা দেখা দেয় ব্যাটিং অর্ডারে, টপঅর্ডার ব্যর্থ হয় প্রতিটি ম্যাচে।

তরুণ ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার মাঝে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান মুশফিক। নির্ভরতার সাথে পূরণ করেন তামিমের শূন্যস্থান। চলতি এশিয়া কাপে নির্দ্বিধায় বলে দেয়াই যায়, মুশফিকের ব্যাট হাসলেই হেসেছে বাংলাদেশ। ৪ ম্যাচে মুশফিকের পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দিচ্ছে এ কথার।

উদ্বোধনী ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খালি হাতে ফিরে যান লিটন কুমার দাশ, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোল্ড হয়ে যান সাকিবও। দলীয় তিন রানের মাথায় সুরাঙা লাকমলের বাউন্সারে ভেঙে যায় তামিম ইকবালের আঙুল। তামিমসহ কার্যত তখন ৩ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ।

সেখান থেকে পরম নির্ভরতা ও দায়িত্বশীলতায় বাংলাদেশ দলকে ২৬১ রানের সম্মানজনক সংগ্রহে নিয়ে যান মুশফিক। পাঁজরের ব্যথার কারণে বড় শট খেলতে ব্যথা লাগার কারণে শুরুতে খেলতে থাকেন ১-২ রান নিয়ে। কিন্তু ক্রমেই রান রেট বাড়ানোর তাগিদে মারতে শুরু করেন হাত খুলে। প্রতিটা শটের পরেই তার চোখে-মুখে ছিলো ব্যথার ছাপ।

তবু খেলে যান একদম শেষ পর্যন্ত। শেষদিকে তামিম ইকবাল ভাঙা আঙুল নিয়ে এক হাতেই ব্যাট করতে নেমে পড়লে বাড়তি সাহস পান মুশফিক। শেষের ১৪ বল থেকেই করেন ৩২ রান। সবমিলিয়ে ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ১৪৪ রান করেন সেদিন তিনি, বাংলাদেশ পায় ১৩৭ রানের বিশাল জয়। যথারীতি ম্যাচ সেরা মুশফিক।

ম্যাচের গুরুত্ব ও মুশফিকের স্বাস্থ্য বিবেচনায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে তাকে দেয়া হয় বিশ্রাম। সে ম্যাচে লেজেগোবরে অবস্থা হয় বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংয়ের। সুপার ফোরের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ফেরেন মুশফিক। কিন্তু ব্যর্থ হন বড় ইনিংস খেলতে, আউট হন ২১ রান করে। বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় অল্প রানে।

ফাইনালে খেলার আশা বাঁচিয়ে রাখতে হারাতেই হবে আফগানিস্তানকে, নতুবা চেয়ে থাকতে হবে অন্য দলগুলোর দিকে। এমন সমীকরণের ম্যাচে ব্যাট হাতে দারুণ শুরু করেছিলেন মুশফিক। খেলতে শুরু করেছিলেন নিজের স্বাভাবিক ছন্দে। কিন্তু হুট করে এক ভুল বোঝাবুঝিতে কাঁটা পড়েন রানআউটের শিকার হয়ে। তবু আউট হওয়ার আগে যোগ করেন গুরুত্বপূর্ণ ৩৩ রান। বাংলাদেশ পায় ৩ রানের রোমাঞ্চকর জয়।

মুশফিক তার ব্যাটসম্যানশিপের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত দেখান পাকিস্তানের বিপক্ষে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে। অঘোষিত সেমিফাইনাল ম্যাচটিতে আবারো ঘটে টপঅর্ডার বিপর্যয়। ১৮ রানে সাজঘরে ফিরে যায় তিন ব্যাটসম্যান। নতুন বলে তখন আগুন ঝরাচ্ছেন জুনায়েদ খান, শাহীন আফ্রিদিরা।

হেরে গেলেই শেষ এশিয়া কাপ, খেলা হবে না ফাইনাল ম্যাচ। এটা মানতে রাজি ছিলেন না মুশফিকুর রহিম। সঙ্গী হিসেবে পেলেন মোহাম্মদ মিঠুনকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো ম্যাচটিতেও মুশফিকের সঙ্গী ছিলেন মিঠুন। সেদিন গড়েছিলেন ১৩১ রানের জুটি। পাকিস্তানের বিপক্ষে করলেন ১৩ বেশি, ১৪৪ রানের জুটি।

ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরিতে মিঠুন ৬০ রান করে ফিরলেও লড়াই চালিয়ে যান মুশফিক। দলকে নিরাপদ সংগ্রহে পৌঁছে দেয়ার মিশনে বেশ সফল ছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যর্থ হন টুর্নামেন্টে নিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি হাঁকাতে। মাত্র ১ রানের জন্য বঞ্চিত হন ক্যারিয়ারের ৭ম ওয়ানডে সেঞ্চুরি থেকে।

তবে তার ৯৯ রানের ইনিংসেই বাংলাদেশ পায় ২৩৯ রানের লড়াকু সংগ্রহ। যা কিনা নিরাপদ সংগ্রহ হিসেবে প্রমাণিত হয় মোস্তাফিজ, মিরাজদের আঁটসাঁট বোলিংয়ে। ইনিংসের ৫০তম ওভার মেইডেন খেলে অলআউট হওয়া ঠেকান পাকিস্তানি পেসার শাহীন আফ্রিদি। তবে ৯ উইকেটে ২০২ রান করা পাকিস্তান হেরে যায় ৩৭ রানের ব্যবধানে। এ ম্যাচেও যথারীতি ম্যাচসেরা মুশফিকুর রহিম।

এখনও পর্যন্ত খেলা ৪ ম্যাচে মুশফিকুর রহিম হাঁকিয়েছেন ১টি সেঞ্চুরি, আরেক ইনিংসে করেন ৯৯ রান। পঞ্চাশ পেরুতে না পারা অন্য দুই ইনিংসেও ছিল ৩৩ ও ২১ রান। সবমিলিয়ে ৪ ম্যাচে ৭৪.২৫ গড়ে ২৯৭ রান করা মুশফিকই এখনো পর্যন্ত টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

শুক্রবার বিকেলে শিরোপা লড়াইয়ে আবারো ভারতের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। সুপার ফোরের ম্যাচে নিষ্প্রভ ছিলো মুশফিকের ব্যাট, করেছিলেন টুর্নামেন্টে নিজের সর্বনিম্ন ২১ রান। ফলে জয়ের দেখা পায়নি টাইগাররা। তবে শিরোপা জিততে হলে ফাইনাল ম্যাচে মুশফিকের ব্যাট হাসার বিকল্প নেই বাংলাদেশের সামনে। কেননা এবারের এশিয়া কাপে মুশফিকের ব্যাট হাসলেই যে হেসেছে বাংলাদেশ!

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮)