চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : কর্ণফুলীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে জমজমাট সুদের ব্যবসা আর দাদন ব্যবসার নিষ্ঠুর লাগামহীন দৌড়। শত শত জেলেরা কষ্টার্জিত মাছ ফিশারিঘাটে তোলার আগেই দাদনদাররা হাজির, কোন কথা বলার সুযোগ নেই ছোটবড় জাহাজ ও ট্রলার মালিকের। নিজের ইচ্ছামতো সব ধরনের মাছ কমিশন ধরে বিক্রি করে হাতে ঘোনা টাকা দিয়ে সোজা বাড়িতে।

এতে অসহায় ট্রলার মালিকেরা। কিছু করার নেই কারণ স্টাম্প নামক সাদা কাগজে বন্দি জেলেরা। গরিবের ঘরে জম্ম নেওয়া জেলেদের কমিশনের ফাঁদে পেলে মালিকও হাজার প্রতি কমিশন খেতে বিভোর। সুদের ভারে গলা পানি ডুব দিতে দিতে জীবনের যাতাকলে অতিষ্ট কর্ণফুলীর হাজার হাজার জেলে পরিবার। যেনো দেখার কেহ নেই।

বাংলাবাজার এলাকার ফিশারীতে মাছ ব্যবসায়ী আনোয়ার জানান, তারা মাছ ধরতে সাগরে যাই ঠিকেই কিন্তু মাছ বিক্রি করে দাদনদার। ফলে ২লাখ টাকার মাছ ১লাখ ৫ হাজার ধরে।

জানা গেছে, চলতি বছরে শুরু থেকেই সাগরে মাছের আকাল, সরকারি বন্ধ, মাছ পেলেও ফিশারিতে দাম পায়না, দাদন টাকার কারনে মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গার মতো অবস্থা, জেলেদের মাথার উপর কৌশলে কথিত ভাগের নাটক, জেলেরা অসহায় তীব্র আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। সঙ্কট উত্তরণে তারা ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায় স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হন।

দাদনদাররাও জেলেদের দুর্বলতা বুঝে চড়া সুদে তাদের কাছে দাদনের অর্থ গুছিয়ে দেয়। এ ব্যাপারে দাদন গ্রহীতাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, দাদন টাকা যতদিন থাকবে ততদিন মণ প্রতি করে কমিশন দাদনদারদের দিতে হচ্ছে। এভাবে বর্তমানে উপজেলার হাজার হাজার ব্যবসায়ীরা খুব হিমশিম খাচ্ছে। সূত্র জানায়, জেলেদের চোখে মুখে হাসি নেই, আছে শুধু হতাশা।

জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের তোলনায় এ বছরে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে, নানা খারাপ আবহাওয়ার কারনে সাগরে যেতে পারছেনা জেলেরা, এদিকে সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়েও আড়তদার বা দাদনদারেরা কম টাকায় কেনাবেচা করাতে দাম পায়না জেলেরা মাছের।

কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মহাজনি সুদ অর্থাৎ দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সাথে আছে ব্যাংকের সুদ। কোথাও স্বর্ণ ব্যবসার আড়ালে আবার কোথাও প্রকাশ্যে চলছে দাদন ব্যবসা। প্রতি এক হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে ৩০০ টাকা সুদ দিতে হয়। যারা দাদন নিচ্ছেন তারা মূলত ব্যাংকের শর্ত ও ব্যাংক কর্মকর্তাতের দুর্নীতি এবং বেসরকারি এনজিও সংস্থাগুলোর কারণে দারস্থ হচ্ছেন দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে।

ঋণ গ্রহীতারা ফাঁকা স্ট্যাম্পে সাক্ষর ও ফাঁকা ব্যাংকের সাক্ষরিত চেক দেওয়ার কারণে পরে তারাই আবার মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে দেনার টাকা পরিশোধ করতে না পেরে কেহ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন আবার অনেকে এলাকা ছেড়ে প্রবাসে।

উপজেলার ইছানগর বাংলাবাজার ঘাট, ব্রিজঘাট নদীর পাড়ের ফিশারীরঘাট, চরপাথরঘাটা, খোয়াজনগর, শিকলবাহা, জুলধা পাইপের ঘোরা, মাতব্বরঘাট, শহরের সদরঘাট এলাকায় দাদন ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ড সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। বর্তমানে ওই সব স্থানগুলোতে প্রকাশ্যে রমরমা দাদন ব্যবসা করে চলছেন।

উপজেলার ব্যবসায়ী ইসলাম জানান, দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নেই। এরপর দাদন ব্যবসায়ীকে ৫ লাখেরও বেশি টাকা পরিশোধ করা হলেও দাদন ব্যবসায়ীর আসল টাকা আর পরিশোধ হয় নি। দাদন ব্যবসায়ীর হুমকির কারণে সে দীর্ঘ সময় নিজেকে আত্মগোপন করে ছিলেন। পরে তার প্রায় ২গন্ডা জমি বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করেন। তার ভিটেমাটি বিক্রি করে দাদনের টাকা পরিশোধ করে বর্তমানে সে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এলাকায় দাপটের সঙ্গে রমরমা দাদন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন সুদী ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দাদন ব্যবসায়ীরা এলাকায় প্রকাশ্যে বেআইনিভাবে ব্যবসা করে চলেছেন। গ্রামের সাধারণ সহজ-সরল মানুষগুলোর কাছ থেকে তারা অল্প কিছু টাকা দিয়ে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সাক্ষর ও ফাঁকা ব্যাংকের সাক্ষরিত চেক নিয়ে পরে তারা আদালতে লাখ লাখ টাকার মামলা ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে শত শত পরিবারকে তারা জিম্মি করে টাকা আাদায় করছেন।

দাদন ব্যবসায়ীর হাতে নিঃস্ব মনছুর জানান, দীর্ঘ দিন থেকে দাদন ব্যবসায়ীর কারণে তিনি এলাকা ছাড়া। আসল টাকার চারগুন টাকা পরিশোধ করেও নিস্তার না পেয়ে বাড়ি ছাড়া তিনি।

কয়েকজন দাদন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রথমে এলাকায় জমি জায়গা বেশি আছে এমন সহজ-সরল সাধারণ মানুষগুলোর দিকে লক্ষ্য দেয়। তাদের পিছনে সময় ও টাকা ব্যয় করে। পরে সংসারের অভাব অনটনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে টাকার বিপরীতে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সাক্ষর ও ফাঁকা ব্যাংকের সাক্ষরিত চেক নেয়।

পরে আসল টাকা উঠে আসলে দাদন সম্রাটরা ওই পরিবারকে ফাঁকা স্ট্যাম্পে সাক্ষর ও ফাঁকা ব্যাংকের সাক্ষরিত চেক দিয়ে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। তারা টাকা পাবে মর্মে লোক জানাজানিও করেন। অনেক পরিবার আত্মসম্মানের ভয়ে জমি জায়গা বিক্রি করে তাদের টাকা পরিশোধ করেন।

অসহায় সাধারণ মানুষ অভাবের তাড়নায় এসব দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে পাঁচগুণ টাকা পরিশোধ করেছেন। এরপরেও তারা ঋণমুক্ত হতে পারছে না।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের বলেন, ‘দরিদ্র মানুষের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে সরকারের। দেশের সকল নাগরিকের ভোটার আইডি কার্ড রয়েছে। এটিকে ভিত্তি করে সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে বা সরকারের অন্য কোনো দফতরের মাধ্যমে বিনা জামানতে ঋণ দেয়া যেতে পারে।

জুবায়ের আরো বলেন, রাষ্ট্রের যে বাজেট তার একটি ক্ষুদ্র অংশ সাধারণ মানুষের জন্য সহায়ক হিসেবে এ পথে ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করেন তিনি’।

পাশাপাশি দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সমাজসেবা অধিদফতর ছাড়াও বাণিজিক ব্যাংকের মাধ্যমে এ জাতীয় ঋণ দেয়া যেতে পারে।

(জেজে/এসপি/অক্টোবর ০২, ২০১৮)