আফতাবুল ইসলাম


পত্নীতলা ও ধামুইরহাট উপজেলা এলাকা মিলিয়ে সংসদীয় আসন নওগাঁ -২। এই আসনে বর্তমান এমপি আওয়ামীলীগের শহীদুজ্জামান সরকার, যিনি জাতীয় সংসদের হুইপ। তিনি আওয়ামীলীগের এমপি হলেও স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা তাকে অনুপ্রবেশকারী বলেই মনে করেন। আসন্ন সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আবার যখন এলাকায় আওয়ামীলীগের প্রার্থিতা নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন অনেকেই মনে করিয়ে দিতে চাইছেন হুইপ শহীদুজ্জামান সরকারের পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয় ও তার আমলে দলে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড উৎপাতের বিষয়টি।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জমা দিয়ে হুইপ শহীদুজ্জামান সরকার মুন্সেফ হন। ভূয়া প্রমানিত হয়ে চাকুরীচ্যুত হওয়ার আশংকার কারণে তিন বছরের মধ্যে তিনি চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন।

শহীদুজ্জামান সরকার নির্বাচনী এলাকার দুইটি উপজেলা পরিষদের গত নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীদের মতামতকে অবজ্ঞা করে নিজের খেয়ালখুশি মতো দুই জন প্রার্থী দেন। ওই নির্বাচনে তার মনোনীত প্রার্থীদের একজন হেরেছেন বিএনপি’র কাছে এবং অপরজন হেরেছেন জামায়াত প্রার্থীর কাছে। এলাকার বাতাসে ভেসে বেড়ানো কথা জানান দেয়, বিএনপি ও জামায়েতের প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করতে হুইপ নাকি স্বেচ্ছাচারী হয়ে দুর্বল ও বিতর্কিত প্রার্থী দিয়েছিলেন!

হুইপ শহীদুজ্জামানের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের পদ-পদবী বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। জাতীয়পার্টির সাবেক পত্নীতলা থানা সভাপতি আব্দুল গফফার এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেক চৌধুরী এখন পত্নীতলা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সিনিয়র সহ সভাপতি। পত্নীতলা উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক আব্দুল মজিদ বিএনপি’র প্রাক্তন নেতা। ১৯টি ইউনিয়নের মধ্যে, ১৭টি ইউনিয়নের কমিটিতে এলাকার অগ্রহনযোগ্য হাইব্রিড অনুপ্রবেশকারীদের সভাপতি ও সেক্রেটারীসহ বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন হুইপ শহীদুজ্জামান। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, ত্যাগী ও বর্ষিয়ান নেতা কর্মীদের কৌশলে কমিটি থেকে দূরে রাখা হয়েছে।

পত্নীতলা ও ধামুইরহাটে বেশ কৌতুক করেই বলা হয় হুইপের আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত এখন ভাই ভাই। জামায়াতের উপজেলা চেয়ারম্যান মঈনুদ্দিনের সঙ্গে সকল রাষ্ট্রীয় এবং স্থানীয় অনুষ্ঠানে হুইপের সহাবস্থান আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের জন্য বিব্রতকর ও লজ্জাজনক। ছাত্র শিবিরের সংগঠন আলোর দিশারীতে প্রধান অতিথি হিসেবে আসন গ্রহণ, জামায়াতের প্রাক্তন পত্নীতলা পৌর নেতা আমজাদ হোসেনের সন্তানদের চাকুরীর জন্য আওয়ামীলীগের কর্মী হিসেবে প্রত্যয়ন, এমন বিব্রতকর অনেক ঘটনারই নায়ক এই হুইপ। হুইপের চারপাশেও এখন বিতর্কিতদের ছড়াছড়ি। শহীদ্দুজ্জামানের পিএস আমিনুল ইসলামের বাবা আব্দুস সোবহান সরকার একজন স্বাধীনতাবিরোধী এবং জামাতের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। শিবিরের প্রাক্তন পত্নীতলা থানা সভাপতি ফারুখ হোসেনকে হেডমাস্টার পদ দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে সদ্য খোলা নজীপুর প্রতিবন্ধী স্কুলে।

হুইপের সাথে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও ত্যাগী আওয়ামীলীগ নেতাদের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। নিজে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেটে জজের চাকুরী নিয়েছিলেন এবং ৩বছরের মধ্যেই তিনি সেই চাকুরী হারিয়েছেন। শ্বশুর জয়পুরহাটের সাবেক এমপি আব্বাস আলী মন্ডলের সুবাদে ও আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক আব্দুল জলিলের মাধ্যমে আওয়ামীলীগে অনুপ্রবেশ করেন শহীদুজ্জামান। তার পিএস আমিনুল ইসলামের স্বাধীনতা বিরোধী বাবা আব্দুস সোবহান সরকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রত্যয়ন দিয়েছেন হুইপ নিজে। তিনি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কোন প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকেন না। যে সকল মুক্তিযোদ্ধা দলে পদ-পদবী ধারণ করে দুর্দিনে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করেছেন হুইপ শহীদুজ্জামান সরকার তাদের সুকৌশলে আওয়ামীলীগ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, তেমন করেই সরিয়েছেন দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের।

হুইপ শহীদুজ্জামানের আমলে ১৫লাখ টাকায় পুলিশের কন্সস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এটা এখন এলাকায় ওপেন সিক্রেট। হুইপ হিসেবে সরকারি তেল ব্যবহারের সর্বোচ্চ রেকর্ড তারই। কাবিখার প্রজেক্টে নিজের দিঘি সংস্কারের কথা এলাকায় কে না জানে! আমাইর ইউনিয়নের সিধাতল মৌজার সংখ্যালঘুদের শ্মশান ঘাটের পুকুর প্রভাবশালীদের নামে লিজ দেওয়া হয়েছে হুইপেরই কারসাজিতে। এলাকার প্রতিটি নিয়োগে মিসেস হুইপকে কমিশন দেওয়া ছাড়া কেউ চাকুরি পায় না, এটা তো এলাকার মুখে মুখে। তার মাকেও নাকি উপঢৌকন দিয়ে স্বার্থ হাসিল করা যায়, এমন কথাও এলাকায় চাউর রয়েছে।

হুইপ ধামুইরহাট উপজেলার আড়ানগর কলেজে নিজের পছন্দের স্বাধীনতা ও আওয়ামীলীগ বিরোধী পরিবারের সন্তান নুরুজ্জামানকে সভাপতি করেন শুধুমাত্র ১৫টি নিয়োগের কোটি টাকা স্বাচ্ছন্দে নিজের পকেটে ঢোকানো নিশ্চিত করতে। নজীপুর প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে হুইপ ১০ থেকে ১৫লাখ টাকা করে নিয়েছেন বক্কর চেয়ারম্যানের মাধ্যমে, এমন খবরও রয়েছে এলাকায়। এম. বায়তুল্লাহ কারিগরী স্কুল এন্ড কলেজের নিয়োগ বানিজ্যও ইতোমধ্যে বক্কর চেয়ারম্যানের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। হুইপের ব্যক্তিগত একাউন্ট মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নজীপুর শাখা ও একই ব্যাংকের ঢাকার ধানমন্ডি শাখার একাউণ্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলেও তথ্য রয়েছে এলাকার মানুষের কাছে। এর বাইরেও অন্য ব্যাংকেও হুইপের একাধিক একাউণ্ট রয়েছে।

দৃশ্যমান দূর্নীতির পরেও দেশে তার কোন দৃশ্যমান অস্থিত্ব নেই। এমনকি নিজের পৈত্রিক বাড়ির অংশও তার ভাইকে দিয়ে দিয়েছেন। এলাকায় হুইপের বিশ্বস্ত জনেরাই বলাবলি করেন, তার ছেলে আতিক জামান শুভ অষ্ট্রেলিয়ার নাগরিক। হুইপ ইতোমধ্যে অষ্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় বহু টাকা পাচার করেছেন এবং সেখানে বিলাস বহুল বাড়িও কিনেছেন। অজ্ঞাত ও রহস্যেঘেরা কারণে সিনিয়রদের টপকিয়ে শিক্ষিকা কাজী মর্জিনা বেগমকে নজীপুর গার্লস স্কুলের হেডমাষ্টার বানিয়ে দিয়েছেন। ওই হেডমাস্টারের স্বামী আব্দুল খালেক চৌধুরীকে হুইপের মাধ্যমে সুপারিশ করিয়ে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাও বানিয়েছেন।

হুইপের আশীর্বাদেই পত্নীতলা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা আব্দুল গাফফারের জামাতা মোফাখখারুল ইসলাম জাদু থানার দালালী পেয়েছেন। শুধু কি তাই, মোফাখখারুল ইসলাম জাদুকে তিনি দলেও ভিড়িয়েছেন! এই জাদুর পুরো পরিবার বিএনপি ও জামায়াতের সাথে জড়িত হলেও তারা হুইপকে ব্যবহার করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

নিজস্ব সুবিধা লাভের জন্য এলাকার কিছু ঠিকাদারকে হুইপ হাতে রেখেছেন, যারা সকল প্রকার সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারী কাজ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। এতে করে সাধারণ ঠিকাদাররা টেন্ডার ড্রপ পর্যন্ত করতে পারেন না। ওই সিন্ডিকেটের দু'জন ঠিকাদার হলেন, শিবনাথ ও আব্দুল মজিদ। এরা বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির সাবেক এমপি সামসুজ্জোহা খানেরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন । এছাড়াও হুইপ শহীদুজ্জামান সাবেক বিএনপির এমপি সামসুজ্জোহা খানের ডানহাত হিসেবে পরিচিত নবাব আলীর ছোট ভাই সাবেক জাতীয় পার্টির ক্যাডার শহীদুল আলম বেন্টুকেও দলে ভিড়িয়েছেন। এরই মধ্যে হুইপ সিন্ডিকেট ঠিকাদার শিবনাথকে পত্নীতলা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আব্দুল মজিদকে পত্নীতলা উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক বানিয়েছেন। হুইপ শহীদুল আলম বেন্টুকে পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি বানিয়েছেন এলাকার টেন্ডার, নিয়োগ তদারকিসহ বিভিন কমিশন বানিজ্য নিয়ন্ত্রনের জন্য। হুইপ নিজের এলাকা ছাড়াও জেলাসদর নওগাঁতেও ঠিকাদার ইকবাল রাসেল, টুনু, বক্করসহ কয়েক জনকে নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ দল তৈরী করেছেন। ওই সংঘবদ্ধ দলটি নওগাঁর পুরো টেন্ডার, নিয়োগ, তদারকিসহ বিভিন্ন বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ধামুইরহাট আওয়ামীলীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, হুইপের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ধামুইরহাট থানা আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সাধারণসম্পাদক ওবায়দুল হক সরকার, ধামইরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান, থানা যুবলীগ সভাপতি জাবিদ হোসেন মৃদু, স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা মাসুদুর রহমান, আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, ধামুইরহাট থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান দিলদার হোসেন প্রমুখ স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে হুইপ একটি চক্র তৈরি করেছেন। এই চক্রই পুরো ধামুইরহাট উপজেলায় তৈরি করেছে এক ত্রাসের রাজত্ব। যার কাছে একেবারেই অসহায় দলের সাধারণ কর্মী ও ভোটাররা। এই চক্র উপজেলার সকল ব্যবসা-বাণিজ্য, স্কুল-মাদ্রাসা ও কলেজে নিয়োগ, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, সরকারি বনভূমি ও খাসজমি দখল, সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া পুরো নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

হুইপের হাত ধরে সম্প্রতি এলাকার ত্রাস হিসাবে পরিচিত বিএনপির কাজী ছবেদুল, সাবেক বিএনপির এমপি সামসুজ্জোহা খানের ঘনিষ্ট নজরুল, লিপ্টন সহ বেশকয়েক জন ক্যাডার পত্নীতলা উপজেলা আওয়ামীলীগে নাম লিখিয়েছে।

হুইপ শহীদুজ্জামানের স্বেচ্ছাচারিতা ও সর্বগ্রাসী লোভের কাছে পত্নীতলা ও ধামইরহাটের আওয়ামীলীগ এখন সংকটাপন্ন। নওগাঁ-২ আসনে শহীদুজ্জামানকে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ ফের মনোনয়ন দিলে এলাকার আওয়ামীলীগের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। অবশ্য স্থানীয় আওয়ামীলীগের বেশীরভাগ নেতাকর্মীই বিশ্বাস করেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দল ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাঁচাতে কার্যকর ও কঠোর সিদ্ধান্তই নিবেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।