সুপন সিকদার : ভোরবেলা শিউলি ফুলের স্নিদ্ধ গন্ধই জানানদেয় মা আসছে। কথায় আছে সনাতন ধর্মালম্বীদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। সারা বছরই উৎসব মুখোর পরিবেশে কাটে। দুর্গাপূজা আসলে উৎসব বেড়ে যায় দ্বিগুণ। কারণ দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। দেবী দুর্গা ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক। তিনি অাদ্যাশক্তি মহামায়া অর্থাৎ মহাজাগতিক শক্তি। 

তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী,গন্ধেশ্বরী,বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী, বাসন্তী প্রভৃতি নামে পূজিত হন। সনাতন শাস্ত্র অনুসারে দেবী দূর্গা দূর্গতিনাশিনী বা সকল দুঃখ-কষ্ট বিনাশকারিণী।

পুরাণ মতে, মহিষাসুর নামক এক অসুর দেবরাজ ইন্দ্রের কাছ থেকে স্বর্গরাজ্য কেড়ে নিয়েছিল। তখন দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহেশ্বর ও অন্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। মহিষাসুর পুরুষের অবাধ্য ছিলেন বলে বিষ্ণু দেবতাদের পরামর্শ দেন যে, প্রত্যেক দেবতা নিজ নিজ তেজ থেকে একটি নারীমূর্তি সৃষ্টি করবেন। এরপর দেবতাদের শরীর থেকে আগুনের মত তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোক পূঞ্জে পরিণত হয়। ঐ আলোক পুঞ্জ থেকে আর্বিভূত এক দেবী মূর্তি। এই দেবীই হলেন দশভুজা দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যাশক্তি মহামায়া অসুর কূলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন করেন। এজন্য দেবী দুর্গাকে মহিষামর্দিনী বলা হয়। দেবী দুর্গা দশভুজা। তাঁর দশটি ভুজ বা হাত বলেই তাঁর এই নাম। দেবী দূর্গা ত্রি-নয়না। তাঁর বাম চোখ হলো বাসনা বা চন্দ্র, ডান চোখ কর্ম বা সূর্য ও কেন্দ্রীয় চোখ হলো জ্ঞান বা অগ্নি।

দেবীদুর্গার দশ হাতের দশটি অস্ত্র দান করেছেন দেবতারা। দেবী দুর্গার দশ বাহুতে যে দশটি অস্ত্র রয়েছে যা শক্তির প্রতীক এবং শক্তিধর প্রাণী সিংহ তাঁর বাহন। সিংহ শক্তির ধারক। দেবী দুর্গাকে দেবতারা যে অস্ত্র দান করলেন, তা হলো— মহেশ্বর দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু ও বাণ, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘণ্টা, যম দিলেন কালদণ্ড, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন রুদ্রাক্ষ মালা ও কমণ্ডলু, সূর্য দিলেন রশ্মি, কালখক্ষ ও নির্মল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দিলেন অক্ষয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলঙ্কার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশুসহ নানা অস্ত্র, অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দিলেন সিংহ, কুবের দিলেন অমৃতের পান পাত্র, শেষ নাগ দিলেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতা তাদের সাধ্যমতো অস্ত্র দিলেন। এ সকল অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তিনি হয়ে উঠলেন দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রতিরূপ।

দুর্গা পূজা কবে কোথা থেকে শুরু হয়ে ছিল তা স্পর্ষ্ট জানা যায়নি। তবে ধারনা করা হয় সত্যযুগের রাজা দুর্গামূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। সত্যযুগের পরে রাবণ বসন্তকালে (চৈত্রমাসে) দেবী দুর্গার পূজা করতেন। এখন সে পূজার নাম বাসন্তীপূজা। রামায়ণে কথিত আছে, শ্রীরামচন্দ্র রাবণের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে দেবী দুর্গাকে সন্তুষ্ট করতে রাম নিজের হাতে দেবীর মূর্তি গড়ে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর বোধন (অকালবোধন) করেন। ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর আরাধনা করে দেবীর পূজা সম্পন্ন করেন। অকালে দেবী দুর্গার পূজা তাই এই পূজাকে বলা হয় অকালবোধন। অকালবোধন এই অর্থে কারণ তখন নাকি মা ঘুমিয়ে থাকেন।

বলা হয় দুর্গা পূজার সঠিক সময় হচ্ছে বসন্তকাল। কারন এ সময় দেবী জেগে থাকেন। তাই এই পুজোয় বোধনের প্রয়োজন হয় না। প্রশ্ন আসতেই পারে তবে কেনো বসন্তকালে দুর্গা পূজা হয়না। বছরে দুবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী পূজা। সনাতন ধর্মে রামায়ণকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মনে করা হয়। তাই শ্রীরামচন্দ্রের শরত্কালের অকালবোধনে দেবীর পূজা মতেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শরত্কালে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে মা দুর্গার পূজা পালিত হয়। গ্রন্থে দুর্গা নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে দুঃ-গম্+অ= দুর্গ। যে স্থানে গমন করা অত্যন্ত দূরূহ তাকে দুর্গ বলে।

দুর্গ শব্দের সাঙ্গে আ প্রত্যয় যোগ করে দুর্গা শব্দটি গঠন করা হয়েছে এবং স্ত্রীলিঙ্গে ব্যাবহার করা হয়েছে। যিনি মহামায়া দুর্গা তাঁকে পাওয়া যায় দুঃসাধ্য সাধনার দ্বারা।তাই তিনিই দুর্গা। আবার দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছেন বলেও তাঁকে দুর্গা বলা হয়। দুর্গা শব্দের আরেকটি অর্থ হলো দূর্গতিনাশিনী দেবী অর্থাৎ মহাবিশ্বের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট বিনাশকারিণী দেবী দুর্গা। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় মহালয়া উদযাপনের মাধ্যমে দেবী দুর্গার আগমনী ঘোষিত হয়। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর বোধন,আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্যদিয়ে পূজার মুল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। দ্বিতীয় দিন: মহাসপ্তমী পূজা- নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমীবিহিত পূজা; তৃতীয় দিন: মহাষ্টমী পূজা,কুমারী পূজা, সন্ধিপূজা; চতুর্থ দিনঃ নবমীবিহিত পূজা; পঞ্চম দিনঃ দশমীপূজা, বিসর্জন ও বিজয়া দশমী।

সনাতন ধর্মের মানুষেরা বিশ্বাস করেন দেবী দুর্গা যেন ঘরের মেয়ে। তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি আসেন। পাঁচদিন থেকে তাঁর ছেলেমেয়েকে নিয়ে আবার কৈলাসে যাত্রা করেন। দেবীকে বিসর্জনের আগে সিঁদুর পরানো, মিষ্টি মুখ করানো এবং বিদায় সম্ভাষণ জানানো হয়। সধবা নারীরা একে অন্যের কপালে সিঁদুর পরান ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন। দুর্গাপ্রতিমা নদীতে বিসর্জনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গা উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। এবছর মা দুর্গার আগমন ঘোটকে চেপে এবং গমন করবেন দোলায়। মা আমাদের জন্য শুভ শক্তি নিয়ে এসে অশুভ শক্তি দূর করবেন এমনটাই বিশ্বাস করেন সনাতন ধর্মের মানুষেরা।

সনাতন ধর্ম মতে, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই মা দুর্গা। শারদীয়া দুর্গা উৎসব কেবল মাত্র সনাতন ধর্মের না এটি এখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের উৎসব। এ যেন এক মহা মিলন মেলা। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এবার সারা দেশে গত বছরের তুলনায় বেশী দুর্গা পূজা হচ্ছে।

দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা আয়-অসুর নিধন করে সুরধ্বনি জাগিয়ে তোল। যাতে আমরা সুরে সুরে মানবের জয় গান গাইতে পারি। যে জয় গানের ভেদ নাই। আসুন আমারা ভেদ ভুলে অভেদ হই। ওইতো মা আসছে। দুর্গতিনাশিনী মা তুমি আসো আমরা যে তোমার জন্য শিউলি ফুলের নৈবেদ্য সাজিয়ে বসে আছি।

(এসএস/এসপি/অক্টোবর ১৬, ২০১৮)