স্টাফ রিপোর্টার : ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, ব্যাংক আমানতের সুদহার নিম্নমুখী ও পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতাসহ নানা কারণে সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার চলতি অর্থবছরে যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, প্রথম তিন মাসেই তার অর্ধেক বিক্রি হয়ে গেছে।

চলতি অর্থবছরের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রথম ৩ মাসেই ১৩ হাজার ৪১২ কোটি টাকার নেট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মোট লক্ষ্যমাত্রার ৫১ দশমিক ২৩ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ হাল নাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক আমানতের সুদের চেয়ে এখন দ্বিগুণ মুনাফা মিলছে সঞ্চয়পত্রে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব ও আস্থাহীনতায় ধুঁকছে পুঁজিবাজার। সবমিলিয়ে এখন সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।

জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে মোট বিনিয়োগ এসেছে ২২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। এ সময় আগে বিক্রি করা সঞ্চয়পত্রের মূল ও সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে মূল পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা এবং মুনাফা বাবদ পরিশোধ করা হয় ৫ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। মূল ও মুনাফা পরিশোধের পর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নেট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৪১২ কোটি টাকা।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্রের উপর সরকারের নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে সুদ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নেয়া তুলনামূলক সহজ হওয়ায় সরকার এদিকেই বেশি ঝুঁকছে। যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের আমানতের সুদের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেশি। এছাড়া নানা কারণে দেশে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কম। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও খুব একটা ভাল না। সব মিলিয়েই নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছেন।

তবে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সংগৃহীত ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয়ের পরামর্শ দিয়েছেন এ অর্থনীতি বিশ্লেষক। তা না হলে এই ঋণ আগামীতে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ সঞ্চয়পত্রের উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হয়।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত কয়েক বছর ধরেই সরকার ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে সঞ্চয়পত্রের উপর বেশি জোর দিচ্ছে। বিগত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) মোট ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে মূল ও মুনাফা পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। আর শুধু মুনাফা বা সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে সঞ্চয়পত্রে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাবাজারে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের মতে সুদহার বেশি হওয়ায় সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশই আসছে এ খাত থেকে। এতে বাজারে সুদহার কমানো যেমন সহজ হচ্ছে না, তেমনি সরকারের বেশি সুদবাহী দায় বাড়ছে। অন্যদিকে বন্ড মার্কেট উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য জমছে। যা সামলাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিল বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এতে পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার যৌক্তিক করার বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে।

সঞ্চয়পত্রে সুদের হার পুনর্নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ ও ব্যাংক পরিচালকসহ বিভিন্ন মহলের চাপ সত্ত্বেও নির্বাচনী বছরে বহুল আলোচিত সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইআরডিকে কাজ করতে বলা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে আগামী নির্বাচনের আগে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাস্তবায়ন করার সম্ভাবনা নাই বলে জানিয়েছেন তিনি।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেনি।

বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মের পর থেকে এই হার কার্যকর আছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।

(ওএস/এসপি/নভেম্বর ০৩, ২০১৮)