স্পোর্টস ডেস্ক : হাঁটি হাঁটি, পা পা করে ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত শ্রেণি টেস্টে ১৭টি বছর পার করে ফেললো বাংলাদেশ। ২০০০ সালের ঠিক এ দিনটাতেই শুরু হয়েছিল ক্রিকেটের কুলীন সম্প্রাদায়ে যাত্রা। যাত্রার শুরুতেই নিঃসন্দেহে শিশুকাল। এরপর দেখতে দেখতে বাল্যকাল। বাল্যকাল পার হওয়ার মুহূর্তেই টেস্টে প্রথম জয়ের দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ।

কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের জয়গান যখন শুরু হয়েছিল, তখন বাংলাদেশ হারিয়েছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মত ক্রিকেট পরাশক্তিদের। এবার টেস্টে বাংলাদেশ টগবগে এক যুবক। এই টগবগে যুবাদের পথ চলবে অনাদিকাল পর্যন্ত। এ থেকে বার্ধক্যে আসার আর কোনো সুযোগ নেই।

কারণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ক্রিকেটের ব্যাটন পরিবর্তন হবে। পৌঁছে যাবে পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী ক্রিকেটারদের হাতে। এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ এবং সাফল্যে সমৃদ্ধ করবে এ দেশের ক্রিকেটকে।

মূলতঃ ১৯৯৭ সালেই ক্রিকেটের জাগরণ শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে, আইসিসি ট্রফি জয়ের মধ্য দিয়ে। সেবার স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন এবং কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই সারা দেশব্যাপি তুমুল এক জোয়ার সৃষ্টি হয়। সেই জোয়ারকে তখন ক্রিকেটের কর্তব্যাক্তিরা পেরেছিলেন সঠিকভাবে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে।

সাংগঠনিকভাবে বিসিবি তখনই ছিলো অনেকটাই এগিয়ে। যার ফলশ্রুতিতে দ্রুত চলে আসে ওয়ানডে স্ট্যাটাস। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট পাকিস্তানকে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয়ার পরই টেস্টের দাবি জোরালো হ এবং ২০০০ সালের জুনে (২৬ জুন) ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা। কিন্তু মর্যাদা ঘোষণা হলে কি হবে, টেস্ট খেলা তো শুরু করতে হবে!

কর্তাব্যাক্তিরা সে অপেক্ষাও বেশি বড় হতে দিলেন না। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে রাজি হয় ভারত। তারিখ ঘোষণা করা হয় নভেম্বরের ১০ তারিখ। সূচি নির্ধারিত হওয়ার দিন থেকেই অপেক্ষার পালা, কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি! দেখতে দেখতে সে দিনটিও চলে আসলো। ভারত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে বাংলাদেশ অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের টস কয়েন নিক্ষেপের মধ্য দিয়েই সূচনা হলো ঐতিহাসিক সূত্রপাতের। যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট আঙ্গিনায়।

অভিষেক ম্যাচটা রাঙিয়ে নেয়ার সব আয়োজনই প্রায় করে ফেলেছিল বাংলাদেশ দল। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসেই ৪০০ রান। চাট্টিখানি কথা নয়। দেশের অভিষেক, নিজেদেরও অভিষেক ম্যাচ। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান আমিনুল ইসলাম দেশের সঙ্গে নিজেকেও ঢুকিয়ে ফেললেন রেকর্ডের পাতায়। যে রেকর্ড ইচ্ছা করলেই কোনোভাবে কেউ মুচে দিতে পারবেন না। দেশের প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি। ৩৮০ বল খেললেও ১৪৫ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন তিনি। হাবিবুল বাশার সুমন খেলেন ৭১ রানের ইনিংস।

অবিস্মরণীয় এই ব্যাটিংয়ের পর ভারতকেও খুব বেশিদুর এগুতে দেয়নি বাংলাদেশ। অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয় দেশের অভিষেক টেস্টেই নিলেন ৬ উইকেট। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের পর ইতিহাসের পাতায় প্রবেশ করলেন দুর্জয়ও।

কিন্তু দুর্দান্ত এই পারফরম্যান্সের পর দ্বিতীয় ইনিংসে গিয়েই বাংলাদেশের দারুণ বিপর্যয়। মাত্র ৯১ রানে অলআউট! হাবিবুল বাশার সুমন করেন সর্বোচ্চ ৩০ রান। প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল আউট হন ৬ রান করে। ভারতের জয়ের জন্য লক্ষ্য দাঁড়ায় ৬৩ রানের। ১ উইকেট হারিয়ে খুব সহজেই জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ভারত।

এভাবেই শুরু হলো টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিযাত্রা। এরপর একে একে কেটে গেলো ১৭ বছর। এই ১৭ বছরে বাংলাদেশ খেলেছে মোট ১০৯টি টেস্ট। এর মধ্যে জিতেছে মাত্র ১০টিতে। ড্র করেছে ১৬টি। বাকি ৮৩টিতে পরাজয়। সিরিজ জিতেছে ৩টি, ড্র করেছে ৭টি এবং হেরেছে ৪৫টি।

এরমধ্যে টেস্টে বাংলাদেশ প্রথম জয় পেয়েছে ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, চট্টগ্রামে। আর দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়, ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ঘরের মাঠে প্রথম ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারিয়েছে বাংলাদেশ।

এখনও পর্যন্ত টেস্টে বাংলাদেশ হারিয়েছে জিম্বাবুয়েকে ৫বার, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২ বার, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কাকে ১বার করে। এর মধ্যে তিনবার বাংলাদেশ জিতেছে রান তাড়া করে। সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড, ২১৭/৬, ২০০৯ সালে গ্রানাডায় স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।

এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে খেলেছেন মোট ৯০জন ক্রিকেটার। এই ১৭ বছরে টেস্টে বাংলাদেশের দলীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ৬৩৮। ২০১৩ সালে গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। দলীয় সর্বনিম্ন রান হচ্ছে ৪৩। চলতি বছরই স্যার ভিভ রিচার্ডস স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।

এর মধ্যে বেশ কিছু স্মরণীয় রেকর্ডও রয়েছে বাংলাদেশের। ২০০১ সালেই টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ট সেঞ্চুরিয়ানের (১৭ বছর ৬৩ দিনে) খেতাব জয় করে নেন মোহাম্মদ আশরাফুল। মুত্তিয়া মুরালিধরনের মত বোলারের বিপক্ষে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেন তিনি। এছাড়া একই ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং ১০ উইকেট নেয়ার রেকর্ড গড়েন সাকিব আল হাসান। সোহাগ গাজী একমাত্র ক্রিকেটর যিনি একই ম্যাচে হ্যাটট্রিকও করেছেন আবার সেঞ্চুরিও করেছেন। দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে সর্বোচ্চ ১১৩ রানের ইনিংস খেলেন আবুল হাসান রাজু।

ব্যাক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ২১৭। ২০১৭ সালের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এই রেকর্ড গড়েন তিনি। দেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেন মুশফিকুর রহীম। এরপর ডাবল সেঞ্চুরি এসেছে তামিম ইকবাল এবং সাকিব আল হাসানের ব্যাট থেকে। সর্বাধিক রান সংগ্রাহক তামিম ইকবাল, ৪০৪৯। সেরা গড় মুমিনুল হকের, ৪২.১২ করে। সেরা বোলিং, তাইজুল ইসলামের। ৩৯ রানে ৮ উইকেট, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১৪ সালে, মিরপুরে। সর্বাধিক উইকেট সাকিব আল হাসানের, ১৯৬টি।

(ওএস/এসপি/নভেম্বর ১০, ২০১৮)