প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

আমার ঘর থেকে শুল্কাদের বাড়ির উঠোন এবং পুকুর ঘাট দেখা যেত কারণ জানলা ছিল। এই জানলাসংলগ্ন আবার তাদের দ্বিতল ক্ষয়িষ্ণু বাড়ি। শিউলি, জবা ও বেলফুলের গাছ ছিল। কী চমৎকার সৌরভ পাঠিয়ে ঘর ভরে রাখতো ঋতুকালে ফুলগুলো! উত্তর দিকে স্বচ্ছ জলের ছোট্ট পুকুর। পুকুরের পশ্চিম দিকে আইনজীবী রেজোয়ান সাহেবের খুব সুন্দর বাসা। পুকুর ঘাটটিও জলে ডুবন্ত। নাসরিনদের বাসা, ভারত থেকে আসা টুকুভাইদের বাসা। এই বাসার পেছনেই মানিকদের বাড়ি। উত্তর পাড়ে জাহাজাকৃতির দুলাল-হেলালদের বাসা। এবং লাগোয়া পৌরসভার রাস্তা। পশ্চিম পাড়ে নূরমহল এবং আমাদের টয়লেটসংলগ্ন একটি বড় বড়ই ও আতাগাছ। এই ঘরে প্রচুর বাতাস আসতো।

প্রকৃতিকে নিয়ে অধিকাংশ ছড়া আমি এই ঘরে বসে লিখেছি হাঁসভাসা, শাপলা-কলমিফুলফোটা পুকুরে নীল আকাশের ছায়া দেখে দেখে। মাঝেমাঝে দুষ্টুমি করে শুক্লা বলতো, ‘কবি কী লিখছো?’ অনেকদিন শুল্কার সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্প করেছি। ওর একটা গভীর মানসিক কমপ্লেক্স ছিল। বাবা মেয়েটিকে খুব স্নেহ করতো হয়তো আমার মতো একই কারণে। শুক্লার বাবা দুটি বিয়ে করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর সন্তান হিসেবে যাদেরকে আমি দেখেছি কমলদা, শ্যামলদা, শতদলদা। তাঁদের মা মারা যাবার পর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান হচ্ছে রেখাদি, শুল্কা, শীলা, সজল, দীপন এবং আরও একটি মেয়ে চিত্রা। এদের মধ্যে শুক্লা ও চিত্রাই ছিল হালকা-পাতলা গড়নের এবং কালো। চিত্রা মানসিকব্যাধিগ্রস্ত। সবভাইবোনগুলোর মধ্যেই সম্ভাব ছিল। শুল্কা কালো হলেও সুশ্রী ছিল, হাসিটা ছিল মিষ্টি।

এই কমপ্লেক্সের কারণে সে একমাত্র কলেজ ছাড়া আর কোথাও যেতো না। কারো সঙ্গেই মিশতো না। একমাত্র বাপ্পিদের বাসা, মালেকমামা আর আমাদের বাসায় যাতায়াত ছিল। মাও তাকে আদরযত্ন করতো। কলেজ থেকে ফিরে ঘরে বই পড়তো আর না হয় ছাদে একাই পায়চারি করতো। সময় পেলেই বই, পত্রপত্রিকা নিয়ে যেতো আমার কাছ থেকে। উপন্যাসগুলোর যে জায়গাটা তার ভালো লাগতো বা তাকে ভাবাতো সেটা নীল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করে রাখতো। পড়ালেখায় ছিল মাঝারিগোছের। মাঝে মাঝে ওদের ঘরে গিয়ে গল্প করতাম। ছাদে হাঁটতাম একসঙ্গে। আমার কোমল কবিমনে একসময় সে একটি গোপন কুঠুরি তৈরি করে নিতে পেরেছিল। মাঝেমাঝে যখন অশান্ত একটা বাতাস এসে ওই নিঃশব্দ কুঠুরির খিড়কিটি খুলে ফেলতো তখন শুক্লাকে দেখতাম একা নীরবে অন্ধকারে মিশে আছে।

অনেক সময় ভেবেছি: আমার একটি বোন যদি এমন কালো হয়ে জন্মাতো সেও কি শুক্লার মতো এমন কমপ্লেক্সে ভুগতো? ওর সঙ্গে এমন একটি সম্পর্ক ছিল ঠিক প্রেমিকাও নয়, আবার সহোদরাও নয়। ‘চাঁদের হাটে’ ওকে টেনেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই রাজি হয়নি। অনেকদিন গভীর রাতে ওর কক্ষ থেকে আকাশবাণীর সম্প্রচারিত অনুরোধের আসরের বাংলা পুরনো গান ভেসে আসতো মিহি শব্দে। একসময় আমি ‘গ’ নামের অপূর্ব সুন্দরী এক কিশোরীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম কিভাবে তারও কানে এলো সেই সংবাদ। একদিন গোধূলিলগ্নে একসঙ্গে ছাদে হাঁটতে হাঁটতে হেসে বললো, ‘‘গ’ আসলেই খুব সুন্দর মেয়ে তোমার সঙ্গে মানাবে ভালো।’ আমি অবাক হলাম এবং দেখলাম সে হাসির মধ্যে কোনো প্রকার ঈর্ষার ঝিলিক নেই! সহজ স্বচ্ছ সাবলীল তার মন্তব্য। আমি বললাম, ‘যা শুনেছো সব সত্যি। তবে সেটা প্রেম নয় শুক্লা, এটা এই বয়সকে জড়িয়ে থাকা একটা মায়া। স্থান-কাল-পাত্র ঘন ঘন বদল করবে কিন্তু কোনোটাকেই ছাড়বে না। কেবল দুঃখ দেবে, নাকে দড়ি বেঁধে ঘোরাবে আর ভোগাবে। এখন আমি সেখানেই আছি।’

শুক্লা আবার হেসে বললো, ‘আমার কথায় কষ্ট পেলে না তো? কোনোকিছু না ভেবেই বলেছি কিন্তু।’ সূর্যটা ডুবছিল টকটকে লাল রং ছড়িয়ে আদিগন্ত আকাশ জুড়ে, লাল মোমের মতো মসৃণ আলোর একটা আভা। সেই আভা এসে আমার বুকের ভেতরটাকেও ছুঁয়েছে। শুক্লা মাথা নিচু করে বললো, ‘সোনা না পোড়ালে কি অলঙ্কার তৈরি করা যায়? যারা পুড়ে পুড়ে জীবনের অলঙ্কার তৈরি করে তারাই শুধু লেখক হতে পারে। তোমার লেখালেখি নিয়ে তোমার বাবা খুব আনন্দিত। তোমাদের মঙ্গল হোক।’ আমি ভেবেছিলাম বাবা আমার অনুরোধটা আমলে নেয়নি। এই বাসায় এসে ওঠার এক সপ্তাহ পরে মা আমাকে নিয়ে গিয়ে ফিলিপস্ এর দোকান থেকে ‘লুলুমুন্ডি’ নামে একটি সিঙ্গেল রেকর্ড বাজানোর প্লেয়ার কিনে দিল। সেইসঙ্গে কিছু রেকর্ড। ফিরে আসতে আসতে রিক্সার মধ্যে বললো, ‘সাবধানে রাখিস। সংসারের টানাটানির মধ্যেও তোর বাবা এটা কিনে দিতে বললো। নষ্ট করিস না।’ এই কথা শুনে আমি আর কী বলবো! বাঁ দিকের বুক পকেটের তলে কী যেন তিকক্ষ্ণ একটা কিছু নড়ে উঠল টের পেলাম!

রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে দারুণ হৈচৈ পড়ে গেল বন্ধুদের মাঝে। পাড়ায় ছড়িয়ে পড়লো খবরটি। প্রথম প্রথম বন্ধুদের নিয়ে ছাদে উঠে সারারাত গান শুনেছি। কিসলুর ঘরে শুনেছি। উৎসাহের আতিশয্যে গান শুনে শুনে ছড়া লিখতে শুরু করলাম। প্রায় প্রতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সাময়িকী ও ছড়া সংকলনে ছড়া প্রকাশিত হতে লাগলো। অবশ্য বন্ধুদের উৎসাহকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘দৈনিক বাংলা’র ‘সাতভাইচম্পা’তে এরপর আরও বেশ কয়েকটি ছড়া প্রকাশিত হয়েছে। এক সময় এমন হয়ে গেল যে, প্রতিদিন বাবা খোঁজ নিত কোথায় কোন্ ছড়া বেরোলো পড়ার জন্য। এক বছরের মধ্যেই সারা দেশের ছড়া লিখিয়েদের সঙ্গে পত্রযোগাযোগ হয়ে গেল। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বিভিন্ন জেলা থেকে ছড়াকার বন্ধুরা ছড়াসংকলন প্রকাশ করত সেখানে ছড়া থাকতো আমার। সাপ্তাহিক কিশোরবাংলায় এইসব ছড়া সংকলন নিয়ে আলোচনা হতো। কিশোরবাংলাতেও ছড়া/কবিতা লিখেছি। ‘চাঁদের হাট’ করার সুবাদে পরিচিত হলাম একসময়কার খ্যাতিমান ছড়াকার আবদুর রহমান, তিনি কিছুদিন কেন্দ্রীয় চাঁদের হাটের আহবায়ক ছিলেন, নিজেও একটি মিনি শিশু ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন।

পরিচয় হল চাঁদের হাটের কেন্দ্রীয় কমিটির আরও লেখক ও কর্মীদের সঙ্গে যেমন চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেন, দাদুভাই তখন বিটিভিতে নাটক লিখতেন। যতখানি মনে পড়ে তাঁর লিখিত একটি নাটক ‘হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপারে’ আফজালভাই প্রথম নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এবং সেটাই তাঁর টিভিতে অভিনয়শিল্পী হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। তারপর নিজেও একসময় নাটক লিখতে শুরু করেন ‘কিশোরবাংলা’র স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি। আফজাল-সুবর্ণা জুটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বিশেষ করে তাঁর স্বলিখিত জনপ্রিয় ‘পারলে না রুমকি’ নাটকটি এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এক সময় গল্প লিখতেন সাংবাদিক আলীমুজ্জামান হারু সাপ্তাহিক রোববারে কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল জহির রায়হানের ভাইপো স্বনামধন্য ছড়াকার, গল্পকার দীদার চৌধুরীর সঙ্গে। নোয়াখালির গুণবতী গ্রামে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে এলে কুমিল্লায় আসতেন, আমাদের বাসায় ছিলেন কয়েকবার। তাঁর সহযোগিতায় অনেক কাগজে আমার ছড়া প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁর হাতেই দেখলাম সাপ্তাহিক না মাসিক একটি মোটা ট্যাবলয়েড পত্রিকা সস্তা নিউজপ্রিন্ট কাগজে মুদ্রিত। নামটি কী ‘পূর্বাভাস’ ছিল? মনে নেই। তাতে প্রচুর নবীন-প্রবীণ লেখকদের লেখা প্রকাশিত হতো। দীদারভাই বললেন, ‘এটাতে লিখে হাত পাকাও।’ তাঁর কথামতো এই কাগজে লাগাতার কয়েক মাস অনেক ছড়া লিখেছিলাম। পরে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় পরিষদের আহবায়ক একসময়কার তুখোড় গল্পকার সাইফুল আলম লিটনের সঙ্গে, এরশাদের আমলে দীর্ঘবছর দৈনিক ইনকিলাবে কাজ করার পর এখন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সহসম্পাদক। দাদুভাইও এই কাগজে এখন কর্মরত। তাঁর হাত দিয়ে কত ছড়াকার যে জন্ম নিয়েছে হিসেব করা মুশকিল। পরিচয় হয়েছিল কেন্দ্রীয় কমিটির কর্মী মাহমুদ আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি একদিন বললেন,‘ ছড়া তো লিখছো ভালো এবার গদ্য লিখো।’ অনুরূপ কথা বাবাও বলছিল, ‘বড়লেখা লেখার চেষ্টা করো। বড়দের জন্যও লিখো।’ তাঁদের এই উৎসাহে চ্যালেঞ্জ নিলাম একটি গল্প লিখবো। ভয় হচ্ছিল ভাষা নিয়ে। কারণ লিখতে গিয়ে তখন সাধু ও চলতি ভাষায় জড়াজড়ি লেগে যাওয়ার বয়স আমাদের।

বাংলা ভাষার ব্যাকরণ যেভাবে শিত্ষা দেয়া হয় তাতে শুদ্ধভাষা শেখা যায় না। স্কুলে কীভাবে শুদ্ধ বানানে, ভাষা প্রয়োগে সাবলীল বাংলায় লিখতে হবে এরকম কোনো শিক্ষা আমাদের সময় ছিল না। এখনো যে নেই তার কারণ তরুণ লেখকদের লেখায় তা সহজেই বোঝা যায়। বহু বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, গবেষক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, রাষ্ট্রদূতের লেখা আমি পড়েছি, লেখা সম্পাদনা করতে গিয়ে দেখেছি কত সহস্র ভুল-ভ্রান্তি! বঙ্গসন্তান হয়েও বাংলা যে তাঁদের মাতৃভাষা এটা আমার মনে হয়নি কখনোই---বিদেশী ভাষা বলে মনে হয়েছে। আর এখন তো ইন্টারনেটের বদৌলতে শত শত বাংলা ওয়েবসাইট যার অধিকাংশই অখাদ্য। এত বানান ভুল এবং বিভ্রান্তকর ভাষার ব্যবহার যে এই প্রতিযোগিতায় বাঙালি চ্যাম্পিয়ান হতে বাধ্য। এর জন্য উদ্যোক্তারা দায়ী নয়, দায়ী সঠিক শিক্ষানীতির অভাব এবং জাতির অভিভাবকদের চরম অবহেলা। বাবা একটা কথা বলতো, ‘যে জাতির মানুষ শুদ্ধ ভাষায় পড়তে, লিখতে জানে না বিশ্বে তার কোনো মর্যাদা নেই এবং সে বড়ই দুর্ভাগা।’

সারাজীবন বাবাকে বাংলা ও ইংরেজিতে সমানভাবে লেখাপড়া করতে দেখেছি। বাবার কলিগরা মুখ টিপে বলতেন, ‘নতুন প্রজন্মের পুলিশ অফিসার, জজ, ম্যাজিস্ট্রেটরা বাংলা তো জানেই না, যে ইংরেজি লিখেন তা দেখে স্যার তো মহাখ্যাপা! গালাগাল করেন মেজাজ যখন চড়ে যায় তাঁর। অফিস আদালত তো স্কুল নয় যে হরদম ভুল ব্যাকরণে লিখিত প্রতিবেদন, বিচারের রায় শুদ্ধ করতে হবে! কত আর করা যায়! দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ভাষার আরও জাত গ্যাছে!’ তখন আমি আমল দেয়নি তাঁদের এইসব কথাবার্তার। কিন্তু এখন বুঝি। বিচারকদের রায়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই কথার সত্যতা। বাবার আগ্রহ ও তাঁর পরিশ্রমে ইংরেজি ভাষাও আমি ভালোই দখল করেছিলাম। জাপানে প্রবাসী হয়ে জাপানি ভাষার প্রবল প্রভাবে সব গুলিয়ে ফেলেছি। বাংলায় লেখার ধরনও বাবা শিখিয়ে দিয়েছে সময় পেলেই। আসলে বিস্তর বইপত্র, পত্রিকা পড়ার ফলে যে কোনো সিরিয়াস পাঠকের একটি শক্ত ধারণা তৈরি হয়ে যায় ভাষা সম্পর্কে। বাবারও তাই হয়ে গিয়েছিল।

বাবা বলতো, ‘লেখার সময় খেয়াল রাখতে হবে ভাষার গতি যেন শ্লথ না হয়, পাঠক যাতে বার বার হোঁচট না খায়। আর বেশি ব্যাখ্যা না করা তাহলে চিন্তাশীল পাঠক তৈরি হবে না। কেননা চিন্তাশীল পাঠক তৈরি করা কিন্তু লেখকের দায়িত্ব। এটা ভুললে চলবে না।’ ...চলবে

আলোকিচত্র : শেষ বয়সে অফিসের কাজে ব্যস্ত বাবা ।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ১৮, ২০১৪)