আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (এআই) মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে দেয়া সর্বোচ্চ খেতাব প্রত্যাহার করে নেয়ার পর তার পাশে দাঁড়িয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ ও নাগরিকরা। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের জেরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সু চিকে দেয়া ‘অ্যাম্বাসেডর অব কনসায়েন্স’ খেতাব বাতিল করার পর দম্ভ প্রকাশ করে মিয়ানমার বলছে, ‘আমাদের কাছে তাদের পুরস্কারের দরকার নেই।’

রোহিঙ্গা নিপীড়নের জেরে বৈশ্বিক সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে সবসময় নীরব ভূমিকা পালন করে আসছেন সু চি। এর ফলে মানবাধিকারের প্রতীক হিসেবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে সু চির যে খ্যাতি ছিল তাও চুর্ন-বিচুর্ন হয়ে গেছে। এর আগেও বেশ কিছু সম্মাননা ও খেতাব হারিয়েছেন মিয়ানমারের এই ডি ফ্যাক্টো নেত্রী।

গত মাসে সু চিকে দেয়া সম্মানসূচক নাগরিকত্ব বাতিল করেছে কানাডা। চলতি বছরের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ তাকে দেয়া পদক প্রত্যাহার করে নেয়।

গণতন্ত্র, শান্তি ও মানবাধিকারের লড়াকু হিসেবে এক সময় বিশ্বের যেসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান সু চিকে প্রশংসার বন্যায় ভাসাতেন; এখন তারা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় মিয়ানমারের এই নেত্রীর কঠোর সমালোচনা করছেন।

২০০৯ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা, পাকিস্তানের শিক্ষা অধিকার কর্মী মালালা ইউসুফ জাই ও চীনের সমসাময়িক শিল্পী এবং মানবাধিকার কর্মী অ্যাই ওয়েই ওয়েইর সঙ্গে সু চিকে ‘অ্যাম্বাসেডর অব কনসায়েন্স’ খেতাব দেয়।

অ্যামনেস্টির মহাসচিব কুমি নাইডু এক চিঠিতে বলেছেন, সংস্থার একজন দূত হিসেবে সু চির কাছে প্রত্যাশা ছিল শুধু মিয়ানমারের ভেতরে নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের অবিচারের বিরুদ্ধে আপনি আপনার নৈতিক কর্তৃত্ব ও ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু আমরা গভীর দুঃখ ভারাক্রান্ত। কারণ আপনি আর আশা, সাহস এবং মানবাধিকার রক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেন না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আপনাকে দেয়া সম্মাননা অব্যাহত রাখার কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না।

বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সমালোচনার মুখে থাকলেও দেশে ও নিজের রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিতে (এনএলডি) সু চির জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। কয়েক দশকের সেনা শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১৫ সালের শেষের দিকে এনএলডি দেশটির জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস জয় পায়।

দলটির মুখপাত্র মিও এনইয়ান্ত ফরাসী বার্তাসংস্থা এনএলডিকে বলেন, ‘খেতাব কেড়ে নেয়া শুধুমাত্র সু চির মর্যাদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং দলের সব সদস্যেরও সম্মানহানি করেছে।’ সু চির এই খেতাব প্রত্যাহারকে ব্যাপক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেন তিনি।

সু চির দলের এই মুখপাত্র সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এসব সংস্থা নাগরিকত্ব পেতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া বাঙালিদের জন্য কাজ করছে। রাখাইনে কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করে এলেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমানো অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করে মিয়ানমার।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক সু চির খেতাব বাতিলের খবর পাওয়ার পর মিয়ানমারের উপ তথ্যমন্ত্রী অং হ্ল্যা এএফপিকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে এতে কষ্ট পেয়েছেন। একই সঙ্গে সু চির সঙ্গে অবিচার করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মিয়ানমারের এই মন্ত্রী। তিনি বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপে সু চির প্রতি মানুষের ভালোবাসা আরো বাড়বে।

সু চির পদক বাতিলের খবর পাওয়ার পর ইয়াঙ্গুনে এনএলডির সমর্থকরা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেছেন। ৫০ বছর বয়সী খিন মং আয়ে বলেন, ‘অ্যামনেস্টির খেতাব বাতিল করাটা একেবারেই শিশুসুলভ আচরণ। এটা অনেকটা এরকম যে বাচ্চারা যখন একে অপরের সঙ্গে পারে না তখন তাদের খেলনা ফিরিয়ে নেয়।’

৬০ বছর বয়সী দলটির আরেক সমর্থক বলেন, আমাদের কাছে তাদের পুরস্কারের প্রয়োজন নেই। গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে দেশটির রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী।

রক্তাক্ত ওই অভিযানের মুখে প্রায় সাত লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা প্রতিবেশি বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ নৃশংস অভিযানের অভিযোগ করেছেন।

তবে দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে বলে দাবি করে আসছে। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা সব ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

(ওএস/এসপি/নভেম্বর ১৮, ২০১৮)