রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান পৃথক দেশের মর্যাদা লাভ করে। এরপর থেকে পাকিস্তানের একাংশ অধুনা বাংলাদেশের হিন্দু স¤প্রদায়ের মানুষ সামাজিক সম্মান, নারীদের নিরাপত্তাহীনতা, সম্পদের নিরাপত্তা, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়া সহ বিভিন্ন কারণে দেশ ত্যাগ করতে থাকে। বর্তমানেও অবস্থা আশানুরুপ না হওয়ায় দলিত ও সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের প্রবণতা অব্যহত রয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক মঞ্চের আহবায়ক ও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু জানান, ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে অবিভক্ত ভারত ভেঙে পাকিস্তানের জন্ম হয়। ২১ শতাংশ মুসলিম জনগনের জন্য ২৭ শতাংশ জমি পায় পাকিস্তান। স্বাধীন পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে পূর্ববাংলা বা অধুনা বাংলাদেশ। পাকিস্তান জন্মের পরপরই সেখানকার হিন্দুরা একে একে ভারতে চলে গেলেও শর্ত অনুযায়ি ভারতের মুসলিমরা পাকিস্তানে চলে যায়নি।

পাকিস্তান সরকারের কাছে তাদের সম্পদ, নারী ও সামিজক নিরাপত্তা নিরাপদ নয় বুঝতে পেরে পূর্ব বাংলার বর্ধিষ্ণু হিন্দু পরিবারগুলো একে একে ভারতে বসতি গড়ে তুলতে থাকে। ফলে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারি দলিত ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন ক্রমশঃ মনোবল হারাতে থাকে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার শত্র“ সম্পত্তি আইন পাশ করায় পূর্ব বাংলার হিন্দুদের কাছে তা অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দেয়। ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের জমি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি পুর্ব বাংলার অনেক হিন্দুর জমি নিয়ম বহির্ভুতভাবে একই শ্রেণীভুক্ত করে তাদের উপর শোষণ ও নির্যাতন চালানো হয়। অনেকেই ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের ফেলে রেখে যাওয়া জমি তাদের শরীকদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে জাল দলিল সৃষ্টি করে।

জমি দখল, বেদখলকে কেন্দ্র করে হামলা, মামলা, নারী সম্ভ্রম লুটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে হিন্দুদের মধ্যে নতুন করে দেশ ত্যাগের প্রবণতা বাড়তে থাকে। এরপরও ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে মুসলিমদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখানকার হিন্দুরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। গণতন্ত্রের মুল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে স্থান পাওয়ায় বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশে হিন্দুরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে বলে আশার আলো দেখে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ ও হিন্দুদের বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপুজার আনুষ্ঠানিকতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বড় নিদর্শণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির ধারালো নখ ও থাবায় ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এরই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারিদের পুরষ্কৃত করতে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান হত্যাকারিদের রাষ্ট্রদূত বানিয়ে বিদেশে পাঠান। এসবের সাথে সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নির্যাতন বাড়তে থাকায় কোনঠাসা হয়ে পড়ে এদেশের সংখ্যালঘুরা। প্রতিবাদ করলে নির্যাতন বাড়তে থাকে।

অ্যাড.ফাহিমুল হক কিসলু আরো জানান, ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যান হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নামক বস্তুটি তুলে দিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়। এতে সংখ্যালঘুদের মনোবলে আরো বেশি চিড় ধরে। ২০০৮ সালে নবম সংসদীয় নির্বাচনী ইস্তেহারে ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবে এমনটি ঘোষণা দেয়। সেক্ষেত্রে সংবিধান থেকে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম কথাটি উঠে যাবে এমন ধারণা হিন্দু স¤প্রদায়ের বুকে আশার আলো জাগায়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও সংবিধানের অনেক কিছু পরিবর্তণ করা হয়েছে। পরিবর্তিত হয়নি কেবল রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম শব্দটি।

এ ছাড়া এরশাদের আমলে শত্রু সম্পত্তি আইন পরিবর্তিত হয়ে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে আইন পাশ করা হয়। বর্তমান সরকারের সময়ে ওই সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির ক ও খ তপশীল এর আওতায় এনে ট্রাইব্যুনাল গঠণ করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। যদিও সাতক্ষীরা জেলায় ট্রাইব্যুনালে মামলা করে বেদখল থাকা জমির মালিকানা ফেরৎ পেয়েছেন এমন কোন নাম তার জানা নেই।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা দলিত ও সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিয়ে গঠিত সংগঠণগুলো দলিত ও সংখ্যালঘুদের নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনায় যথাসময়ে কার্যকরী ভুমিকা না রাখা, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি না রাখা, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মহানবীকে কটুক্তির কাল্পনিক অভিযোগ এনে হিন্দু শিক্ষকদের বাড়ি ভাঙচুর করে তাদেরকে জেলে পাঠানোসহ নারীদের কৌশলে ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলোতে দোষীদের শাস্তি না হওয়া ও সম্পদের নিরাপত্তা না থাকায় এদেশের সংখ্যালঘুরা ক্রমশঃ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। হিন্দু স¤প্রদায়ের মধ্যে একতার অভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও জনগনের সম্মিলিত প্রতিবাদ সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

সাতক্ষীরা জেলা মন্দির সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিত্যানন্দ আমিন জানান, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংখ্যালঘু নির্যাতন, মন্দিরে হামলা হলেও তারা মামলা করতে পেরেছেন থানায় বা আদালতে। বিএনপি, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকালিন কালিগঞ্জের ফতেপুরে আওয়ামীলীগ নেতা গোবিন্দ লাল সরদার, বিশ্বনাথপুরে ধীরেন সরকার, ডেমরাইলে নরেন মণ্ডল, শামনগরের ভুরলিয়ায় দেবেন মণ্ডলসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের উপর হামলা বা নির্যাতন হয়েছে সেসবের অধিকাংশই থানায় বা আদালতে মামলা হলেও দলীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নির্যাতিতরা বিচার পায়নি। ফলে অনেকেই দেশ ত্যাগ করেছে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালিন স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মঞ্চস্ত নাটকে মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে এমন মিথ্যা ঘোষণা ও দৃষ্টিপাত পত্রিকায় ২০১২ সালের ৩১ মার্চ ও পহেলা এপ্রিল ফতেপুর ও চাকদাহে ১২টি হিন্দু পরিবারের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে বিরান ভূমিতে পরিণত করা,২০১৩ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি ও পরবর্তী কয়েক মাসে সদরের আগরদাড়ির গোপাল ঘোষাল, তাপস আচার্য, শিয়ালডাঙার নব কুমার মণ্ডল, দেবহাটার মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ ঘোষসহ বিভিন্ন হিন্দু বাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এর ঘটনায় দায়েরকৃত অধিকাংশ মামলায় বিচার না হওয়ায় সংখ্যালঘুদের মনোবল ভেঙে পড়েছে।

আশাশুনির খড়িয়াটির শ্মশান সরকারিভাবে মুসলিমদের নামে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে পরে তার একাংশ বাতিল করলেও সৎকারের জন্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয় সরকারি উদ্যোগ না নেওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভুতিকে চরম আঘাত পেয়েছে। দেবহাটার সখীপুর ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন রতন কর্তৃক মাঘরী গ্রামের অশোক ঘোষ, দীনবন্ধু ঘোষের জায়গা জবরদখলের চেষ্টা, পারুলিয়ার তপন বিশ্বাসের গুদাম ঘরসহ কোটি টাকার সম্পদ জবরদখল করার চেষ্টাসহ সদরের মহাদেবনগরের কলেজ ছাত্র গৌতম সরকারকে নৃশংসভাবে হত্যার ফলে ওই এলাকার হিন্দুরা সেখানে বসবাস করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছে।

সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন প্রতিহত করার কাজে সরকার, রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যথাযথ ভূমিকা রাখলে তাদের মনোবল অনেকাংশে বেড়ে যাবে । সেক্ষেত্রে তারা দেশ ত্যাগের মত কঠিন সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকবে। তবে ধর্মীয় নেতারা তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর কঠোর আলোচনা রেখে সংখ্যালঘুদের পক্ষে মানবিকভাবে পাশে দাঁড়ালে উভয় সম্প্রদায়ের আন্তরিক মেলবন্ধনকে সুদৃঢ় করলে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের প্রবণতা কমবে বলে মনে করেন নিত্যানন্দ আমিন।

(আরকে/এসপি/নভেম্বর ১৫, ২০১৮)