উত্তম গোলদার, মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) : আজ ভয়াল সেই ১৫ নভেম্বর। আজ থেকে ১১ বছর আগে ২০০৭ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা। মির্জাগঞ্জে সিডরের আঘাতে ১০ হাজার ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত এবং ১১৫ জন নারী, পুরুষ ও শিশুর প্রাণহানীসহ অনেক সম্পদের ক্ষতি হয়। 

আংশিক ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয় ১৪হাজার ৫শত ঘর, গবাদিপশু মারা যায় ২ হাজার ৫শত, হাঁস-মুরগি মারা যায় ১লাখ ৩০ হাজার, ফসল বিনষ্ট হয় ১১ হাজার ৯৯০ একর জমির,৭ হাজার ৯৮৭ টি পুকুরের প্রায় কোটি টাকার মাছ ভেসে যায়, এছাড়াও উপজেলার ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ২৪০টি মসজিদ সম্পূর্ন বিধ্বস্ত হয়, ৩৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ১৫৬ কিলোমিটার কাচাঁ সড়ক ও ৩৫ কিলোমিটার বাধঁ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়ন।

এই ইউনিয়নে বিধ্বস্ত হয় ১ হাজার ১৭০টি ঘর এবং মৃত্যু ঘটে ৮৫ জনের। এর মধ্যে চরখালী গ্রামে মারা যায় ৪৫ জন। ঝড়ের তীব্রতা কমে যাওয়ার পর শুরু হয় স্বজনদের খোঁজাখুজি। কারো বাবা নেই,মা নেই। আবার কারো নেই কোলের সন্তান, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী। ধান ক্ষেতে পড়ে আছে লাশ এমনকি গাছের ডালে ঝুলে আছে বাবার প্রিয় সন্তান।

সিডরের স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি মির্জাগঞ্জের মানুষ। ওই রাতেই চরখালী ও রানীপুর গ্রামে দুইটি সন্তানের জন্ম হয় এবং একটি পুত্র সন্তানের নামকরন করা হয় সিডর। সিডরের এগারো বছর অতিবাহিত হলেও মির্জাগঞ্জের প্রলয়ঙ্কারী ঘূনিঝড় সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবার এখনও তাদের বসত ঘরে ফিরতে পারেনি।

অন্যদিকে পায়রার ভাঙ্গনের কারনে ২০ গ্রামের মানুষ আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এ এলাকার মানুষ পায়রা নদীর ভাঙ্গন রোধে শক্ত বেড়িবাঁধ নির্মানের দাবী জানান পায়রা তীরবর্তী লোকজন। সিডরের ভয়াবহতা চরখালী ও মেন্দিয়াবাদ গ্রামের মানুষেরা আজও ভুলতে পারেনি। একদিকে জলোচ্ছাসের তান্ডবে সর্বস্ব হারিয়ে তারা নিঃস্ব,অন্যদিকে আবার ঝড়ের আশঙ্কায় ক্ষতিগ্রস্থ এ পরিবারগুলো এখনও পায়রা নদীর পাড়ে বেড়ি বাঁধের ঢালে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি মির্জাগঞ্জ উপজেলার সিডর ক্ষতিস্তগ্ররা। আকাশে মেঘ দেখলেই এখনও আতকে উঠে তারা। সব কিছু হারিয়ে তারা অনেকেই ঢাকায় গেছে কাজের সন্ধানে। সিডরে মারা যাওয়া লাশ গুলো চরখালী খান বাড়ির পুকুর পাড়ে ২৪টি কবরে ৩৩টি লাশ দাফন করা হয়। গনকবরটি এখন অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে। তাদের এইদিনে স্মরন করা হয় না।

উপজেলার কপালভেরা গ্রামের পালোয়ান বাড়িতে একই ঘরে স্বামী-স্ত্রীসহ মারা যায় ৬জন। মেন্দিয়াবাদ গ্রামের মাজেদা বেগম বলেন,পায়রা নদী থেকে ৪০ ফুট দুরে ছিল তার ঘর। সিডরের পর দিন ঘরের একটি খুটিও খুঁজে পায়নি সে। মাজেদা বেগমসহ এ রকম জমি না থাকা এ এলাকার ৬টি পরিবারকে থাকার জন্য রানীপুর গ্রামের ইসমাইল হাজি মেন্দিয়াবাদ গ্রামের ২০ শতাংশ জমি দান করেন। সেই থেকে এখানেই তাদের বসবাস। এর মধ্যেই মেন্দিয়াবাদ এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। স্বজন হারা ব্যাথা নিয়ে কাটছে তাদের জীবন।

একইভাবে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে শত শত পরিবার সবর্শ্ব হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। উপজেলা সদরস্থ সুবিদখালী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু সুভাষ চন্দ্র শীল ওই রাতে বিদ্যালয়ের আশে পাশের লোকজনকে বিদ্যালয়ের দোতালায় তুলতে সক্ষম হলেও তিনি পাশে সুবিদখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে দুটি চাম্বল ও একটি তালগাছসহ ওই বিদ্যালয়ের ওপর উপরে পরলে তিনি ঘটনা স্থলে মারা যান এবং পরদিন সকাল নয় টারদিকে গাছ চাপা অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

সদ্য যোগদানকৃত মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত যারা এখনও ঘর পাননি তাদেরকে পর্যায়ক্রমে পূর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ‘যাদের জমি আছে,ঘর নাই’ তাদের জন্য এই প্রকল্পের আওতায় উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে মোট ২৮২টি অসহায় গৃহহীন পরিবারকে টয়েলেটসহ এটি করে ঘর নির্মানের কাজ চলমান আছে।

(ইউজি/এসপি/নভেম্বর ১৫, ২০১৮)