আন্তর্জাতিক ডেস্ক : তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার প্রায় দেড় মাস হয়ে গেছে। তবে এ হত্যায় কে জড়িত এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি কোনো পক্ষই। একপক্ষ দাবি করছে খাশোগি হত্যার নির্দেশদাতা সৌদি যুবরাজ সালমান তবে অন্য পক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করছে। আর বিষয়টি যে আলোচনায় আছে তার পেছনে রয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক। নানান তথ্য-প্রমাণ আসার পরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সৌদির বিরুদ্ধে কিছুই বলছেন না। আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ক্রমাগতভাবে এ হত্যার জন্য সৌদির ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। খাশোগির হত্যার আড়ালে তাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে আছে কিনা তাই উঠে এসেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন।

গত বৃহস্পতিবার সৌদি প্রসিকিউটর আনুষ্ঠানিকভাবে খাশোগি হত্যায় জড়িত ১১ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করেন। এদের মধ্যে পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। সৌদি প্রসিকিউটরের এমন ঘোষণার পর ট্রাম্প প্রশাসনও নতুন করে সৌদির ১৭ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু হত্যার নেপথ্যে থাকা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে কেউই অভিযুক্ত কিং-বা দায়ী করে না।

সিএনএন বলছে, এই দুই ঘটনা কোনোভাবেই কাকতালীয় নয়। দুই পক্ষ থেকে একসঙ্গে এরকম ঘোষণার পেছনে আছে একটা বড় উদ্দেশ্য। মূলত যুবরাজ সালমানের বিরুদ্ধে খাশোগি হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ দিন দিন যত বাড়তে শুরু করায় তাকে বাঁচাতেই একসঙ্গে এ ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে দুই দেশ।

কিন্তু গত শুক্রবার যে ঘটনাটি ঘটেছে তা দুই পক্ষের এই পরিকল্পনায় ছাই ঢেলে দিয়েছে। মার্কিন তদন্ত সংস্থা সিআইএ খাশোগি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের পর জানিয়েছে যে, গত ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে খাশোগিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। মার্কিন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও এ ঘটনার সম্পর্কে অবগত একটি সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানায় সিএনএন।

এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিথার নওয়ার্ট বলেছেন, কারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে না। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর আমরা পাইনি।

খাশোগি হত্যার সঙ্গে যুবরাজ সালমান জড়িত বলে মার্কিন তদন্ত সংস্থা সিআইএ যে মূল্যায়ন দিয়েছে এখনও সেটা অস্বীকার করছে সৌদি আরব। কিন্তু যদি সিআইএর এই তদন্ত শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে এতদিন ধরে সৌদি আরবের সঙ্গে ট্রাম্পের যে সম্পর্ক সেটা কি একটা বড় ধাক্কা খেতে পারে।

কেননা কনস্যুলেটের ভেতরে খাশোগিকে হত্যার ব্যাপারে প্রথম থেকে নানারকম ব্যাখ্যা দিয়ে আসছিল সৌদি আরব। আর সে কারণেই পুরো ঘটনাটা প্রকৃতপক্ষে কি সেটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খাশোগি নিখোঁজ হওয়ার পর রিয়াদ প্রথম অস্বীকার করে তারা এ ব্যাপারে কিছু্ই জানে না। কিন্তু চাপে পড়ে ঘটনার সপ্তাহখানেক পর সৌদি অ্যাটর্নি জেনারেল শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেন খাশোগিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

সিআইএর দেয়া তদন্ত প্রতিবেদন সত্ত্বেও ট্রাম্প তার মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধু মোহাম্মদ বিন সালমানকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। গত শনিবার তিনি পুনরায় এ ঘটনায় যুবরাজ সালমানের সম্পৃক্ততা নেই বলে তার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা জানান।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘এ হত্যায় যুবরাজ সালমানের কোনো হাত নেই। সৌদি আরব আমাদের সত্যিকারের একজন ঘনিষ্ট মিত্র। তারা আমাদের অনেক কাজ ও ব্যবসার জন্য অনেক সুযোগ দেয়। যা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’

এমন মন্তব্যের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের বাদশাহ ও বন্ধু সালমানের পক্ষ হয়েই কথা বলছেন। আর তার বক্তব্যে এটা পরিস্কার যে, একজন সাংবাদিকের জীবন তার লাভজনক অস্ত্র ব্যবসা আর বাণিজ্য চুক্তিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে না।

তবে খাশোগি হত্যা নিয়ে সৌদি আরবের ওপর সবচেয়ে বড়ে চাপটি আসছে তুরস্কের পক্ষ থেকে। দেশটি বলছে ওইদিন কনস্যুলেটে ঢোকার পরপরই খাশোগিকে হত্যা করে তার মরদেহ টুকরো টুকরো করা হয়। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী তার মরদেহ অদৃশ্য করে দেয় সৌদি আরবের পাঠানো ১৫ সদস্যেল কিলিং স্কোয়াড।

কিন্তু খেয়াল করার মতো বিষয় হলো তুরস্কের কর্মকর্তারা কিন্তু খাশোগি হত্যা নিয়ে প্রতিদিন অল্প অল্প করে তথ্য দিচ্ছে। আর এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য হলো খাশোগি হত্যা ইস্যুতে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ ধরে রাখতে চাচ্ছে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আলোচনায় একটা নেতিবাচকতা নিয়ে প্রতিনিয়ত সৌদি আরব আলোচিত হোক এটাই তাদের লক্ষ্য।

ঘটনার প্রায় একমাস পর তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয় খাশোগি হত্যার অডিও রেকডিং তাদের হাতে আছে। এছাড়া সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেছেন, পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর কাছে খাশোগি হত্যার রেকডিং পাঠিয়েছে আঙ্কারা।

তুরস্কের এই একটু একটু করে তথ্য দেয়ার কারণে সৌদি কর্মকর্তরা খাশোগি হত্যা নিয়ে তাদের গল্প বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর মাধ্যমেই মূলত সৌদি আরব বলতে বাধ্য হয়েছে যে, খাশোগিকে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা হত্যা করেছে।

কিন্তু খোদ তুরস্কেই বর্তমানে সাংবাদিকরা একটা ভয়াবহ নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় কি হলো যে তুরস্ক খাশোগি হত্যার বিচার নিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার ভূ-রাজনীতি বিষয়ক গবেষক আইহাম কামেল বলছেন, সচেতনভাবেই সৌদি আরবের ওপর আরও আক্রমণাত্মক ও দেশটিকে বিশ্বে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার জন্যই এ কাজ করছে তুরস্ক।

আইহাম কামেল বলেন, ‘এই অঞ্চলে সুন্নিদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ হত্যাকাণ্ডকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সৌদি আরব এবং তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারে দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ। তুরস্ক এই ঘটনাটিকে ব্যবহার করে এই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বাড়ানোর কাজটি করছে।’

কিন্তু বৈশ্বিক এ রাজনীতি আর ভূ-রাজনীতির খবর পাচ্ছে না নিহত সাংবাদিক খাশোগির পরিবার। তারা এখনও তাদের স্বজনের মরদেহ পাওয়ার আশায় আছে। প্রকৃতপক্ষে খাশোগির মরদেহের আদৌ অস্তিত্ব আছে কিনা তাও এখনও জানা যায়নি। এদিকে গত শুক্রবার তুরস্ক, মক্কা ও মদিনাসহ বেশ কয়েকেটি স্থানে খাশোগির গায়েবানা জানাজা সম্পন্ন হয়েছে।

গত দেড় মাস ধরে খাশোগি হত্যা নিয়ে ধোয়াসা তৈরি হয়েছে তার মাধ্যমে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, খাশোগি হত্যার সত্য উদঘাটিত হয়নি আর এই সত্য কখনো উদঘাটন হবেও না।

(ওএস/এসপি/নভেম্বর ১৮, ২০১৮)