প্রবীর বিকাশ সরকার : মাঝে মাঝে ভাবি, ভাবতে হয়, ভাবায় বলেই ভাবতে হয়।

দেড়শ বছরও হয়নি জাপান আধুনিক সভ্যতার আলো গ্রহণ করতে নিষিদ্ধ দরজা খুলে দিয়েছিল ১৮৬৮ সালে। প্রায় ২০০ বছরের জন্য বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা দেশটি যখন উন্মুক্ত হল বিশ্বের কাছে তখন এই ঘটনাকে বলা হল মেইজি ইশিন বা মহাসংস্কার। সেই থেকে জাপান ক্রমাগত গ্রহণ-বর্জন-সংযোজন-সংশোধন-সংস্কার করে চলেছে। প্রশান্ত সাগরীয় এই দ্বীপবর্তী দেশটির সমস্যা-সংকটের কোনো শেষ নেই। প্রাকৃতিক দানব ভূমিকম্প সবসময়ই হানা দিচ্ছে, আঘাত হানছে সঙ্গে নিয়ে সামুদ্রিক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসকে। তাছাড়া মহাযুদ্ধতো একাধিক গেছে তার ওপর দিয়ে। হিরোশিমা-নাগাসাকির ব্যাখ্যাতীত আণবিক ঘটনাজনিত মহাক্ষতি ও বিপর্যস্ততা এখনো কাটিয়ে ওঠেনি-- এখনো জীবন্মৃত হাজার-লক্ষ হিবাকুশা (যাঁরা বোমার আঘাতে অসুস্থ হয়ে টিমটিম করে বেঁচে আছেন) জাপান সরকারের আর্থিক সাহায্যনির্ভর। তবুও যাঁরা পারছেন কোনো না কোনো একটি কাজে ব্যাপৃত আছেন। কাজ ছাড়া এই জাতিকে চিন্তা করা কষ্টসাধ্য। জাপানিরা যেন কাজের জন্যই এই ধরাতে জন্ম নিয়েছেন।

বিগত প্রায় দেড়শ বছরে কতদূর যেতে পেরেছে জাপান? কতদূর সে যায়নি বলাই বরং যুক্তিসঙ্গত। গ্রামীণ সভ্যতার দেশ জাপান আজকে এত পরিবর্তিত হয়েছে যে চিন্তা করতে গেলে মাথার মধ্যে গোলমাল লেগে যায়। মাটি থেকে মহাকাশ পর্যন্ত কোথায় নেই জাপান! কী না তৈরি করে সে বিশ্বকে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছে! ক্রমাগত সে আবিষ্কার, উদ্ভাবন এবং অন্বেষণ করে চলেছে। যেমন সৌন্দর্যগুণে গুণান্বিত তার সৃজনশীলতা তেমনি চারিত্রিক দিয়ে অত্যন্ত অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহলপ্রবণ এবং মহাধৈর্যশীল জাপানের নাগরিকদের করেছে তুলনাহীন। ৩০ বছর ধরে এই দেশে বসবাসের সুযোগ পেয়েছি তার তল খুঁজে পাচ্ছি না।

জাপানিতে একটি প্রবচন আছে: “গামুবারেবা নানতোকা নারু”, অর্থাৎ “লড়াই করলে একটা কিছু হবে”, ঠিক প্রবচন নয় এটাই জাপানিদের বেঁচে থাকার, প্রতিদিন এগিয়ে চলার আপ্তবচন। তাই তারা কোনো পরিস্থিতিতেই হিশেহারা হন না, সমস্যাটাকে বোঝার ও চালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। দেখেছি যাঁরা বিদেশি তাঁরাও দীর্ঘদিন থাকলে জাপানিদের মতো হয়ে যেতে বাধ্য। এটাই জাপানের শিক্ষা। যে সমাজে তুমি থাকবে সে সমাজের একজন হয়ে যেতে হবে রীতিনীতি মেনে।

আজকে জাপানে সব কাজকর্মই অটোমেশন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জাপান সরকার বা কোনো রাজনীতিক কোনোদিন ‘ডিজিটাল জাপান’ স্লোগান দিয়ে উন্নতির কথা বলেনি। যুগের তালে তালে উন্নতির ছোঁয়া এসে লাগবেই। উন্নতি জোর করে করা সম্ভব নয় জনগণের সঙ্গে থেকেই করতে হবে এটাই নিয়ম। জনগণের দ্বারা একবার পরিত্যক্ত হলে এই দেশে দ্বিতীয়বার উঠে দাঁড়ানো কত যে কঠিন তা বলে বিশ্বাস করানো মুশকিল। জাপান হচ্ছে বিশ্বাসের দেশ। বিশ্বাসহারানো মানে পচে পচে মিলিয়ে যাওয়া ধীরে ধীরে।

এইসব কথাগুলো ভাবছিলাম নগর দপ্তরের দিকে যেতে যেতে। কেী দেশ! মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখলাম একদল বিভিন্ন বয়সের পথচারী কাগজের থলির মধ্যে কী যেন কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমা করছে। মাত্র ৩-৪ জন মিলে তাদেরকে পরিচালনা করছে। কাছে গিয়ে জানলাম তারা একটি মানসিক সেবা পরিচর্যাকেন্দ্রের সদস্য, অর্থাৎ তারা মানসিকভাবে অসুস্থ, ভারসাম্যহীন। প্রতি সপ্তাহে তাদেরকে পথ থেকে ময়লা ও আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য বাইরে নিয়ে আসা হয়। এর অর্থ তারা যে সমাজের বিচ্ছিন্ন কেউ নয়, তারাও এই দেশের নাগরিক এবং কিছু হলেও তারা সমাজে অবদান রাখছে। যদিওবা তাঁদের মানসিক শক্তি নেই সাধারণ


নাগরিকদের মতো প্রতিদিন অফিস-আদালত, ব্যবসা বা কলেকারখানায় শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ রোজগার করার। তারা অভিভাবক কিংবা নগর প্রশাসনের কল্যাণ তহবিল থেকে ভাতা পেয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। তাই পথঘাট পরিস্কার-পরিচ্ছিন্ন রাখার সহজ কাজটি তারা করছে যতখানি সম্ভব। কারো মুখেই কোনো বিরক্তি বা অস্থিরতার ছাপ দেখলাম না।

শুধু তাই নয়, অনুসন্ধান করে দেখলাম, প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজের ব্যবস্থাও এই দেশে আছে। মনে পড়ল, যখন চাকরি করতাম তখন আমাদের সঙ্গে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছেলেমেয়েরাও কাজ করত। সব কর্মকর্তাই তাদের দিকে নীরবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। প্রতিবন্ধীরা যাতে ভালো থাকে, আনন্দে থাকে তাদেরকে সেইভাবে পরিচালিত করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। খেলাধুলার ব্যবস্থা, জন্মদিন উদযাপনও করা হয় মানসিক হাসপাতাল বা পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে।

নগর দপ্তরে গিয়েছিলাম একটি কাজে। একটি বিশেষ কার্ড করার জন্য। সেটা থাকলে নগর দপ্তরে না গিয়েও যেকোনো ২৪ ঘণ্টা খোলা কনভিনিয়েন্ট স্টোরে গিয়ে কাজ সমাধা করা সম্ভব। ছুটির দিনে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। অবশ্য ছুটির দিনে দপ্তরের প্রাঙ্গণে মেশিন স্থাপিত আছে সেখানে কার্ডটি দিয়ে চাহিদা পূরণ করা যায়। জনসেবা কোথায় এসে পৌঁছেছে!

জাপানিরা দ্রুত কাজ করার মানব-মেশিন সেতো জানি। কিন্তু দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই কার্ডটি করতে একজন নারী কর্মীই ছিলেন যথেষ্ট। কাউকে কিছু বলতে হল না, অনুরোধ করতে হল না, কাউকে ফোন করতে হল না, বরং কয়েকজন গাইড আছেন তারা এখানকার কর্মচারীই অদলবদল করে গাইড করেন আগতদেরকে। চুপচাপ নিঃশব্দে কাজ করছেন সবাই। অভিযোগ থাকলে বাক্সো আছে সেখানে অভিযোগ লিখে রাখা যায় বা সঙ্গেসঙ্গে নির্ধারিত কাউন্টারে গিয়ে কথা বললেই হল। কোনো ফাঁকি-ঝুঁকির বালাই নেই এখানে। হাম্পি-দাম্পি করলে দুমিনিটেই পুলিশ এসে যাবে।

এই দেশের মানুষের বড় শক্তি হচ্ছে তার শিক্ষাগুণ আর নিয়মিত কর পরিশোধ করার মানসিকতা। করই তার নিরাপত্তার প্রধান হাতিয়ার। আইনজীবী, পুলিশ আর রাজনীতিকও এই আওতার বাইরে নয়।

লেখক : জাপান প্রবাসী