অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান


বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এসব সংশোধনী কেবল আওয়ামী লীগ সরকার একা আনেনি বরং এ সংশোধনীগুলোর অল্প কয়েকটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার এনেছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় সংবিধানের আমূল চরিত্র পরিবর্তন করেছে স্বৈরাচারী শাসকরা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন করা থেকে সংবিধানের মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তন করেছে সামরিক শাসকরা। সামরিক শাসকরা সংবিধানের প্রধান প্রধান ধারা সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের চরিত্র বদল করে। রাজনীতি আসলে কী? ডিকশনারি অনুযায়ী পলিটিক্সের অর্থ হচ্ছে ‘ওয়ে অব গেইনিং পাওয়ার।’

এছাড়া রাজনীতির আর কোনো সংজ্ঞা নেই। সত্যিকার অর্থেই রাজনীতি কেবল ক্ষমতা অর্জনের পথ। রাজনীতি করাই হয় ক্ষমতা লাভের জন্য। ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়াই রাজনীতি। এ অর্থে নির্বাচন এলেই কীভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া যাবে, তা নিয়ে রাজনীতি করা স্বাভাবিক ব্যাপার। কাজেই ক্ষমতা পাওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনে ভোটে জেতার জন্য সবাই লড়েন। বর্তমানে রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও সেই ধারার ফলস্বরূপ হলেও এ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সম্প্রতি নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক জোটগুলোর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব মিডিয়ার সৃষ্ট বাস্তবতা। যেমন- বছর দুই আগে বন্যার সময় ভারত থেকে শেরপুর জেলায় একটি হাতি চলে আসে। হাতিটি পানি থেকে উঠতে পারছিল না। ৭/৮ দিন এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ভারত থেকে উদ্ধারকর্মী এসে উদ্ধার কাজ চালিয়েও ব্যর্থ হয়।

এক সময় হাতিটি মারা যায়। সেই সাত-আটদিন ধরে আমাদের গণমাধ্যম হাতির ঘটনাটি লাইভ দেখাত। হাতিটি এখন কোথায় যাচ্ছে? কী খাওয়ানো হচ্ছে? ইত্যাদি। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম আব্দুর রবদের তথাকথিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সেই বন্যহাতির মতো। পানিতে পড়ে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত জোট নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। এই জোটের ভোটে জয়ের স্বপ্ন ছাড়া অন্য কোনো তাৎপর্য নেই। জোটনির্ভর রাজনীতি হচ্ছে নির্বাচনকেন্দ্রিক। কয়েকদিন মিডিয়ার এজেন্ডা হিসেবে এটি থাকবে। এক সময় অন্য ইস্যু সম্মুখে আসবে। জোট হারিয়ে যাবে।

সম্প্রতি একটি দৈনিকের জরিপে দেখানো হলো দেশের ৫৬ শতাংশ ভোট বিএনপির। তবে নির্বাচনের আগে পত্রিকাটি আরো দুই-তিন বার এমন জরিপ দেখাবে। এমনকি ৭৫ শতাংশ ভোট বিএনপির, তাও দেখাবে এই সুশীল পত্রিকাটি। তবে এগুলো বিশ্বাস করার মতো কোনো জরিপ নয়। ভোটের পরিসংখ্যানও ওঠানামা করে। এসব জরিপ বিভ্রান্তিকর। তবে বর্তমানে রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তকারী লোকের উপস্থিতি ব্যাপক।

ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের মতো একজন লোকের উপস্থিতিই যথেষ্ট। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের কোনো দল নেই, লোক নেই। তিনি কোনো দলের নেতাকর্মীও নন বলেন নির্দলীয় ব্যক্তি। কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী সব রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনি কোনো না কোনোভাবে জড়িত। এমন লোককে যখন জোটের মঞ্চে দেখা যায়, তখন জোটের উদ্দেশ্য নিয়ে নিশ্চিত থাকা যায় না। আ স ম আব্দুর রব এরশাদ শাসনামলে ৭০টি দল নিয়ে ‘কফ’ নামে ‘কম্বাইন অপজিশন ফ্রন্ট’ তৈরি করেছিলেন। আজকে তাদের এই জোট গঠনের নেপথ্যে ক্ষমতায় যাওয়াটাই মুখ্য।

মাহমুদুর রহমান মান্নার বাড়ি যদি গোপালগঞ্জে এবং আ স ম আব্দুর রবের বাড়ি বৃহত্তর ময়মনসিংহে হতো, তাহলে তারা আওয়ামী লীগ জোটে আসতেন। মাহমুদুর রহমান মান্না হিসাব করে দেখেছেন, বগুড়ায় ধানের শীষ ছাড়া নির্বাচনে পাস করার কোনো উপায় নেই। এর আগে আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা নিয়ে পাস করতে পারেননি। আ স ম আব্দুর রবের অবস্থাও একই। তিনি যে এলাকার সেখান থেকে নৌকা নিয়ে পাস করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তাদের বাড়ি যদি ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ কিংবা গোপালগঞ্জে হতো, তাহলে তারা আওয়ামী জোটেই যোগদান করতেন। কেননা রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতা দখল। কারণ এমপি নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাবান হওয়ার সুযোগ আছে।

এক সময় গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সামরিক শাসক এরশাদের বন্ধু ছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন করেন ওষুধ নীতিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির বিষয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যদি সেই সময় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের মতো মেয়াদোত্তীর্ণ নেতাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতেন তাহলে আজকের মতো অবস্থায় পড়তে হতো না।

সম্প্রতি পৃথক দু’টি টকশোতে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন এবং ডা. জাফরুল্লাহর অপকর্ম আমরা লক্ষ্য করেছি। কাজেই টকশোতে কেন ডিজিটাল আইন লাগবে না? কারণ দেশের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি, উস্কানি, ইন্ধন দেয়া এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ লোকগুলোই যথেষ্ট। তাদের নেতা বলা যায় না। কারণ তাদের কোনো অনুসারী নেই। ডা. জাফরুল্লাহকে নিয়ে গণস্বাস্থ্যের অনেকে এখন বিব্রত। ডা. জাফরুল্লাহ এখন অসুস্থ। সপ্তাহে কয়েকবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। তার বুদ্ধি, বিবেক উপলব্ধিবোধ এখন সেইভাবে কাজ করছে না। যে যা বলে দিচ্ছে, তাই তিনি ব্যক্ত করছেন। কাজেই তাদের মতো লোকদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জোট ভাঙা গড়া স্বাভাবিক। যাই হোক, দেশ এখন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ড. কামাল হোসেন এক সময় আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গণফোরাম গঠন করেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগে অনেক সন্ত্রাসী আছে এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিচ্ছেন। কিন্তু সেই সময়ই তিনি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক করেন মোস্তফা মহসীন মন্টুকে। যারা আশির দশকে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদত দিত তাদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে এ নামটি আসত। সে সময় সানাউল হক নুরু, বাবলুর জন্য ক্লাসরুমে ফ্লোরিং করতে হতো। অনবরত গোলাগুলি চলত। এ সময় সার্জেন্ট জহুরুল হক হলটি দখলে রেখে যুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে কাজ করত মোস্তফা মহসীন মন্টুর ‘ক্যাডার’ মাসুম। মাসুম বাহিনী আর নীরু-বাবলু বাহিনী সম্মিলিতভাবে ছাত্রলীগকে জগন্নাথ হলে পুরো অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। নীরু এখন ‘জাস্টিস ফর হিউম্যানিটি’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছে। সেখানে মঈনুল হোসেনের মতো জাতির বিবেক হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছেন।

রাজনীতিতে অন্যতম একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। এটি একটি ত্রিপক্ষীয় ঘটনা। এক. আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী, দুই. প্রশাসনের সর্বোচ্চ লোকজন। পুলিশের আইজি থেকে শুরু করে ডিজি এবং তিন. রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তারেক জিয়াসহ অনেকে। একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ধারাকে একেবারে শেষ করে দেয়ার জন্য এই হামলা চালানো হয়। তবে হামলার ষড়যন্ত্র প্রমাণ করা বড় কঠিন। ষড়যন্ত্র কেউ প্রকাশ্যে করে না। গ্রেনেড হামলার সময় আমি স্পটে উপস্থিত থাকার কারণে দেখেছি, ঘটনার পরপরই টিয়ার গ্যাস দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সব অন্ধকার করে দেয়া হয়। যেন না দেখা যায় কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। রাতের অন্ধকারে ফায়ার ব্রিগেডকে দিয়ে সমস্ত রক্ত মুছে ফেলা হয়।

গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন টিভি চ্যানেলের ভিডিও ফুটেজ নিয়ে যায়। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়। জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়। যে বিচারপতি এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। এটি ছিল ত্রিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী আক্রমণ। এসব কুশীলব বিচারের অধীনে চলে এসেছে। ন্যায্য বিচার হয়েছে। জাতি আর একটি কলংকের দায় মোচন করেছে।

লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।