কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : দেশসেরা উর্বরা কৃষি জমি ও উদ্ধৃত্ত খাদ্য শষ্য উৎপাদনের অঞ্চল খ্যাত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা কুষ্টিয়া। জেলার মোট ১লক্ষ ৬২হাজার হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ১লক্ষ ১৭হাজার হেক্টর কৃষি জমি হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে অতি উর্বরা তিন বা অধিক ফসলী কৃষি জমির পরিমান- মাত্র ৭৬হাজার হেক্টর। 

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছর এসব কৃষি জমিতে উৎপাদিত খাদ্য শষ্য জেলার প্রায় ২২ লক্ষ মানুষের বার্ষিক খাদ্য চাহিদা পূরন করেও উদ্ধৃত্ত খাদ্য শষ্য দেশের অন্যান্য জেলায় খাদ্য সরবরাহের যোগান দিচ্ছে। সর্বশেষ উৎপাদন বর্ষেও এই জেলা থেকে অন্তত: ২লক্ষ ১হাজার মে:টন উদ্ধৃত্ত খাদ্য অন্যত্র সরবরাহ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করছেন জেলার কৃষি বিভাগ।

খাদ্য শষ্য উৎপাদনে এমন গৌরবময় অর্জন থাকলেও জেলায় ক্রমবর্ধমান কৃষি জমি ধ্বংসের শংকার কথা জানাচ্ছেন তারা। বিশেষ করে বেপরোয়া ইটভাটা মালিকদের কৃষি জমি আগ্রাসনকে এক আত্মঘাতি ঘটনা হিসেবে দেখছেন কৃষি বিভাগ।

ইটভাটা মালিকরা তাদের কাজকে বে-আইনী বলে স্বীকার করেই বলছেন, কিছুই করার নেই; কারণ এসব দেখার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের সবাইকে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে ম্যানেজ করেই হচ্ছে এসব। তবে এমন অভিযোগ নাকচ করাসহ সংশ্লিষ্টরা একে অন্যের উপর দায় দিচ্ছেন। কেউবা বলছেন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র হলো- নামকাওয়াস্তে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই একটি অভিযান পরিচালিত হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না এমনই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অবশেষে পাল্টা-পাল্টি এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমে বিধি লংঘনের সত্যতা পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন দুদক কুষ্টিয়ার অভিযানিক দল।

বিধি মতে, জেলায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থানের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে যথাযথ নিয়ম মেনে লাইসেন্সসহ আনুষঙ্গিক ছাড়পত্র নিতে হয়। জেলা প্রশাসন ইটভাটা স্থাপনে চুড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানত: কৃষি বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ইতিবাচক ছাড়পত্র আছে কি না সে বিষয়টি দেখেন। অর্থাৎ কোন ভাটা মালিক ভাটা স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে কৃষি বিভাগ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর হতে ছাড়পত্র নিয়ে চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জেলা প্রশাসনে আবেদন করবেন। কিন্তু কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষি জমিতে গড়ে উঠা কেবলমাত্র তালিকাভুক্ত প্রায় ১৫২টি ইটভাটার মালিকদের কেউই উলেøখিত নিয়ম মেনে ভাটা স্থাপন করেননি।

এমন অভিন্ন চিত্রের সত্যতা নিশ্চিত করে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জোবায়ের হোসেন চৌধুরী জানালেন, ভুমি জোনিং এ্যাক্ট-২০১০, কৃষি জমি সুরক্ষা আইন-২০১৫, পরিবেশ সুরক্ষা আইন-১৯৯৫সহ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনে আইনগত নীতিমালা-২০১৩ সবই লংঘিত হয়েছে উপজেলার সকল ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে। সরেজমিনে অভিযানে গিয়ে তাদের কাছে ইটভাটা স্থাপনে লাইসেন্স বা ছাড়পত্র কিছুই পাওয়া যায়নি।

কথিত ইটভাটা মালিক সমিতির বশির উদ্দিন, আব্দুল হাকিম, মহিদুল, মনিরুল, খোকনসহ আরও একাধিক সদস্যের সাথে আলাপকালে তারা জানান, আমরা ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরেই নিয়মিত টাকা দিচ্ছি। আমরা যদি অবৈধ হই তাহলে আমাদের কাছ থেকে এসব টাকা কেন নেয়া হচ্ছে? আবার কেনইবা মাসে মাসে চাঁদে চাদে প্রশাসন অভিযানের নামে এসে জরিমানা আদায় ও ভাটা ভাংচুরসহ নানা ভাবে আমাদের আর্থিক ক্ষতি সাধন করছেন? আমরাও তো দেশ উন্নয়নে অবকাঠামো নির্মানের গুরুত্বপূর্ণ উপকরন ইট তৈরী করছি। আমরাও চাই এর একটা সঠিক সমাধান হোক।যেহেতু অধিকাংশ ভাটা মালিকই আইন-কানুন সম্পর্কে খুব একটা সচেতন নয়। কোন্ জমিতে ভাটা করলে কৃষি ও পরিবেশ ধ্বংস হবে না সেটা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনই ঠিক করে দিন। টাকা যখন দিচ্ছি; তাহলে আমাদের সুবিধা-অসুবিধাও দেখতে হবে প্রশাসনকে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামার বাড়ি) কুষ্টিয়ার উপপরিচালক বিভুতি ভুষন সরকার বলেন, কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে কৃষি ধ্বংসের একমাত্র এবং অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইটভাটা। বিগত এক দশকে জেলার অতি উর্বর তিন ফসলী ৭৫হাজার ৮শত ৮০হেক্টর কৃষি জমির মধ্যে ২শত ৮৮হেক্টর জমিতে গড়ে উঠা দেড় শতাধিক ইটভাটা প্রত্যক্ষভাবে ধ্বংস করেছে। এছাড়া এসব ইটভাটার দুষণ ও বিরূপ প্রভাবে চুতুর্দিকে আরও ৪গুন জমি ফসলহানির শিকার হচ্ছে। এতো কিছু জানার পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি জমিতে কিভাবে ভাটা স্থাপনে ছাড়পত্র দেবে ? কৃষি বিভাগ থেকে কোন প্রকার ছাড়পত্র ছাড়াই কৃষি জমিতে দেদারসে ইটভাটা গড়ে উঠলেও আমাদের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নাথাকায় কিছুই করার নেই। ইটভাটা মালিকদের ‘সবাইকে ম্যানেজ’ প্রক্রিয়ার সাথে কৃষি বিভাগ কোন ভাবেই জড়িত নয় বলে তিনি দাবি করে জানান, এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) ড. হায়াৎ মাহমুদ জেলার কৃষি উৎপাদনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, দিনে প্রতি একজনের মাথাপিছু খাদ্য চাহিদা ৪৮৭গ্রাম হিসেবে ধরে জেলার ২২লক্ষ মানুষের একদিনের খাদ্য যোগানে প্রয়োজন ১০৭১.৪ মে:টন এবং বার্ষিক খাদ্য চাহিদা যোগানে প্রয়োজন ৩লক্ষ ৯১ হাজার ৬১ মে:টন খাদ্যশস্য। জেলার সর্বশেষ বার্ষিক খাদ্য শস্য উৎপাদনে অর্জিত লক্ষমাত্রা ছিলো- ৫লক্ষ ৯২ হাজার মে:টন (শুধুমাত্র চাল, গম ও ভুট্টার হিসেব ধরে) যা বার্ষিক খাদ্যের যোগান দিয়েও ২লক্ষ এক হাজার মে:টন খাদ্য শস্য উদ্ধৃত্ত ছিলো।

এছড়াও অন্যান্য খাদ্য শস্য যেমন চিনি, সব্জী, ডালবীজ কলা প্রভৃতিও রয়েছে। উদ্ধৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশের হাতে গোনা কয়েকটি জেলার মধ্যে কুষ্টিয়া অন্যমত। এই সফলতা অর্জনে জেলার কৃষি বিভাগ নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এতদ্সত্তে¡ও নানাবিধ কারণে উদ্ধৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের এই ধারা অব্যহত রাখাটা ক্রমান্বয়ে শংকাগ্রস্ত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে কৃষি জমিগুলি ক্রমবর্দ্ধমান গতিতে যেভাবে নানামুখি অকৃষিজ খাতে চলে যাচ্ছে তাতে কৃষি উৎপাদনের মূল আঁধার যে জমি তার সিংহভাগই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এসব কৃষি জমি রক্ষায় জরুরী ভিত্তিতে সরকার প্রয়োজনীয় কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন এটা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোন প্রকার অনুমোদন ছাড়াই ইটভাটার মালিকরা ‘সবাইকে ম্যানেজ’ করে, বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অতি উর্বর তিন ফসলি কৃষি জমিতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নীতিমালা লংঘন করছে; দুদক সদর দপ্তরে প্রাপ্ত এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনকে সাথে নিয়ে পরিচালিত অভিযানে ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন বলে জানালেন দুদক কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক হাফিজুল ইসলাম।

পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার সিনিয়র কেমিষ্ট মিজানুর রহমান বলেন, জেলায় প্রায় দেড় শতাধিক ইটভাটার মধ্যে মাত্র ২৬টি ইটভাটা স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়া থাকলেও অন্যদের কোন ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। তবুও কিভাবে এসব ভাটা চলছে তা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বলতে পারবেন। তবে এসব অবৈধ ভাটা মালিকদের সাথে পরিবেশ অধিপ্তরের কারো সাথে কোন অনৈতিক সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন তিনি।

কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ ওবাইদুর রহমান জানান, জেলায় ভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে ভাটা মালিকরা নীতিমালা লংঘন করেই এসব করছেন। তবে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ ইচ্ছে করলেই জমির শ্রেনী পরিবর্তন করতে পারবেন না। কৃষি জমিকে অকৃষিজ দেখিয়ে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে এমন অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানালেন তিনি।

(কেকে/এসপি/নভেম্বর ২১, ২০১৮)