গোলাম আনোয়ার : 

পুরুষ শাসিত এই সমাজের একটি ব্যাধি হচ্ছে নারী নির্যাতন। সমাজ সভ্যতা যতো এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, ততোই যেন এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে। মানুষ যতোই সচেতন হচ্ছে, ততোই যেন নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে উদাসীনতা। 

দেখা যায় সমাজের শিক্ষিত সচেতন ও প্রভাবশালী মানুষের দ্বারাই নারী সহিংসতার ঘটনা ঘটছে বেশি। তার চিত্র সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি সারা বিশ্বে নারীরা যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে ‘মি টু’ মুভমেন্ট দেখে। কিন্তু কতখানি ফলপ্রসূ এসব আন্দোলন? প্রশ্ন থেকেই যায়। ফলে প্রভাবপ্রতিপত্তির মাধ্যমে তারা অপরাধ থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। নারীর ওপর পুরুষের অবিরাম ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সাম্প্রতিককালে এই নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে।

দারিদ্র, বেকারত্ব ও অশিক্ষার কারণে পদে পদে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পেরে অসংখ্য নারীর জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাকসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। তাছাড়া, এইসব আইন সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ সচেতনও নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পৃথিবীব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে। কারণ তারা মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে।

আজ ২৫ নভেম্বর ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন’ বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এই দিবসটির ইতিহাসে মিশে আছে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্রপট যা নারী সহিংসতারোধে চেতনা জাগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে তিনজন নারী নির্যাতিত হন। এ ঘটনার স্মরণে ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে প্রথম লাতিন আমেরিকায় নারী অধিকার সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে নির্যাতন বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পক্ষকালব্যাপী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৩ সালের ২৫ নভেম্বর জাতিসংঘ ‘নারী নির্যাতন দূরীকরণ ঘোষণা’ প্রকাশ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের খসড়া অনুমোদন করে প্রতিবছর ২৫ নভেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন দূরীকরণ দিবস’ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

নারীদের উপর সহিংসতার আরেকটি কারণ হল এদের উপর সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। নারী নিজ পরিবারেও নির্যাতিত হচ্ছে। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না বরং পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে সহ্য করছেন বাধ্য হয়ে।

বছরের পর বছর নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে আন্দোলন বা দিবস পালন করেও কি নির্যাতন কমছে? হয়তো সঠিক কোন উত্তর মিলবে না। বাংলাদেশের একটি চিত্র তুলে ধরলে অনেকখানি পরিষ্কার হওয়া যাবে বিষয়টির ব্যাপারে, একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হয় নারীর ওপর তার পুরুষ সঙ্গীর শারীরিক নির্যাতনের বেলায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে শতকরা ১৪ ভাগ মাতৃমৃত্যু ঘটছে গর্ভকালীন নির্যাতনের কারণে। শতকরা ৬১ জনের বেশি পুরুষ এখনও মনে করে স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করা বৈধ। এছাড়া, নারীর প্রতি শতকরা ৮০ ভাগ সহিংসতা ঘটে পরিবারের ভেতরে। অন্যদিকে দেশে সংঘটিত মোট খুনের ঘটনার ৫০ ভাগই হচ্ছে স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার ঘটনা। নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে গ্রামাঞ্চলে। শহরাঞ্চলেও শতকরা ৬০ ভাগ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। মৌখিক নিপীড়নের শিকার হন ৬৭ শতাংশ নারী। তাছাড়া যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বছরে গড়ে ছয়শটি।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে অতীতেও। অবশ্য তখন মানুষের মধ্যে এতো সচেতনতা ছিল না। তখন নারী নির্যাতন যে একটা অপরাধ সেটা হয়তো অনেকে জানত না। এখন সময় পাল্টাচ্ছে। শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়েছে মানুষ। সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে সকল ক্ষেত্রেই। কিন্তু নারী নির্যাতনের মতো একটি মারাত্মক স্পর্শকাতর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। নারী সহিংসতা রোধে আছে আইন, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সনদ ও চুক্তি। কিন্তু এগুলোর কোন বাস্তবায়ন নেই। এসব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। সর্বোপরি আইন প্রয়োগকারী ও আইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী ও দরিদ্র মানুষের প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে শুধু আন্দোলন নয়। নারী সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধ করতে পারবে যার মাধ্যমে নারী পাবে সহিংসতার প্রতিকার, গড়ে উঠবে নারী সহিংসতা মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ। তাই নারীদের প্রতি আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। নারীদের কথা বলতে হবে নিজ নিজ অধিকার আদায়ে।

লেখক : শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।