নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়ন ও আত্রাই উপজেলার বিষা ইউনিয়নে ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। 

নামধারী শ্রমিকরা মাঠে না থাকলেও ব্যাংকে টাকা উত্তোলন করেন বোরকা পরে গিয়ে। এ কর্মসূচির আওতায় ৯দিনের প্রায় লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। আবার কোন কোন ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কর্মসৃজন কর্মসূচির শ্রমিকদের দিয়ে নিজের জমির ধান কেটে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সরকার থেকে এলাকার উন্নয়নের বরাদ্দগুলো এভাবে ভাগাভাগি করে পকেট ভরছেন কর্মকতা ও চেয়ারম্যানরা। অপরদিকে নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কর্মসৃজন কর্মসূচির শ্রমিকদের দিয়ে নিজের জমির ধান কেটে নিচ্ছেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নিজের জমির ধান হেটে নিয়ে শ্রমিকদের মজুরী দিচ্ছেন ওই কর্মসূচির টাকায়। বিষয়টি এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।

আত্রাই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস ও বিষা ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ইউনিয়ন পরিষদের মাটিকাটা অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) আওতায় ৪০ দিনের কর্মসূচীতে রাস্তায় মাটি কাটার কাজ চলমান আছে। ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মাস্টার রোল খাতায় ১৪৬ জন নারী-পুরুষের নাম আছে। প্রতিদিন ২শ’ টাকা করে তাদের পারিশ্রমিক। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সাপ্তাহিক ছুটি বৃহস্পতি ও শুক্রবার। পারিশ্রমিক ২শ’ টাকা হলেও ১৭৫ টাকা শ্রমিকদের দিয়ে বাকী ২৫ টাকা সঞ্চয়ের জন্য কেটে রাখা হয়।

গত রবিবার ইউনিয়নের ৫ নং ওয়াডের্র ক্ষুদ্র বিষা গ্রামের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষরা ক্ষুদ্র বিষা গ্রাম থেকে উদয়পুর গ্রামের প্রায় দেড় কিলোমিটার বাঁধের রাস্তা নির্মাণের কাজ করছেন। সেখানে উপস্থিত একটি খসড়া খাতায় ৯টি ওয়ার্ডের ৯৩ জন নারী-পুরুষের নাম আছে। হাজিরা খাতা থেকে দেখা যায় সেদিন ১০ জন অনুপস্থিত ছিলেন। কাজ শুরু হওয়ার পর ২৪ নবেম্বর পর্যন্ত পিআইও অফিস থেকে কোন কর্মকর্তা সেখানে যাননি। কিন্তু ২৫ নবেম্বর পিআইও অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের হাজিরা খাতা দেখে স্বাক্ষর করেন। এবং সেদিন সেই খাতায় ১০ জন অনুপস্থিত দেখান। কিন্তু বাস্তবে সেদিন অনুপস্থিত ছিল ৬৩ জন শ্রমিক।

সেখানে হাজিরা খাতা মূলত লোক দেখানো। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বার জহুরুল ইসলামও জানেন না সেখানে মূলত কতজন শ্রমিক থাকবে। কারণ মাষ্টার রোল তাকে দেখানো হয়নি এবং বলাও হয়নি। মাস্টার রোল খাতায় ১৪৬ জনের নাম থাকলেও মুলত কাজ করেন ৯৩ জন। বাকী ৫৩ জনের নাম কেউ জানে না এবং তাদেরকে কেউ কোনদিনও এইখানে কাজ করতে দেখেনি। এ ৫৩ জন শ্রমিকের ৯দিনে প্রায় লক্ষাধিক টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে আত্মসাত করা হয়েছে। এছাড়া ৯৩ জনের মধ্যে যারা অনুপস্থিত থাকেন তাদেরকের উপস্থিত দেখিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়। যারা নিয়মিত কাজ করেন, তারাও জানেন না কত শ্রমিক কর্মসূচীতে কাজ করছেন। কিন্তু ব্যাংকে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে অনেকেই টাকা উত্তোলন করেন। অর্থাৎ তালিকাভূক্ত নামধারী শ্রমিকরা কাজ না করেও নিয়মিত কাজে উপস্থিত দেখিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যান টাকা তুলে আত্মসাত করছেন।

১ নং ওয়ার্ডের রানীনগর গ্রামের সামাদ আলী বলেন, ৯দিনের মধ্যে কাজে ২দিন অনুপস্থিত ছিলেন। খসড়া হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত দেখানো হলেও তাকে উপস্থিত দেখিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। টাকা উত্তোলনের দিন ব্যাংকের দরজায় লক্ষ্মী মেম্বার তার কাছ থেকে ৩শ’ টাকা জোর করে নিয়েছে। পারমোহনঘোষ গ্রামের মমতাজ আলী বলেন, এই কাজে যারা অনুপস্থিত থাকে তাদেরকেও ব্যাংকে টাকা উত্তোলনের সময় হাজির দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়। আমাদের প্রত্যেকের পাশ বই পিআইসিরা নিয়ে রাখছেন। আবার ব্যাংকে দেখা যায়, আমাদের যারা কখনো কাজ করেনি অনেক মহিলা বোরকা পরে এসে সেই টাকা উত্তোলন করেছেন। তাদেরকে আমরা চিনিও না।

খরসতা গ্রামের চায়না বিবি বলেন, আমরা যারা কাজে অনুপস্থিত থাকি তাদেরকে হাজির দেখিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়া হয়। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে দরজার বাহিরে আসার পর মহিলা মেম্বাররা অনুপস্থিত থাকার টাকা জোর করে নিয়ে নেয়। ৪নং ওয়ার্ডের ভাঙ্গাজাঙ্গাল গ্রামের মোফাজজল শেখ জানান, ভুট্রা লাগানোর জন্য ৩ দিন কাজ করিনি। ব্যাংক থেকে ওই ৩ দিনের টাকা তুলে নিয়েছিলাম। টাকা নিয়ে বের হওয়ার সময় মহিলা মেম্বার বিউটির স্বামী রকিব হোসেন জোরপূর্বক ৪৫০ টাকা নিয়ে নেন। এই কর্মসূচির কাজ যারা করছেন তারা অনুপস্থিত থাকলে তাদেরও বেতন উঠানো হয় এবং একইভাবে সকলের নিকট থেকে টাকা নিয়ে নেন তারা।

৫ নং ওয়ার্ড মেম্বার জহুরুল ইসলাম জহের বলেন, ক্ষুদ্র বিষা গ্রাম থেকে উদয়পুর বাঁধ পর্যন্ত রাস্তার কাজ হচ্ছে। কাজের পিআইসি মহিলা মেম্বার ময়না ও লক্ষ্মী রানী। কতজন শ্রমিক কাজ করছেন সে তালিকা কাউকেই দেখানো হয়নি। শ্রমিকরা কাজে অনুপস্থিত থাকলেও শতভাগ উপস্থিত দেখিয়ে পিআইও অফিসের কর্মকতা ও ইউপি চেয়ারম্যানের যোগসাজসে ব্যাংক থেকে ঠিকই টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। অনিয়মের বিষয়টি প্রশাসন তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে দাবি জানান।

উপসহকারী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান বলেন, ১৪৬ জনের নামের তালিকা তাদের কাছে আছে। ২৫ অক্টোবর ঘটনাস্থলে গিয়ে খসড়া খাতায় ৯৩ জনের মধ্যে ১০ জন অনুপস্থিত পান। বাকীগুলোর বিষয় তিনি জানেন না। ইতোপূর্বে তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার সময় পাননি বলেও জানান। তবে যারা অনুপস্থিত থাকে তাদের টাকা দেয়া হয়না বলেও তিনি দাবী করেন।

আত্রাই উপজেলার বিশা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রকল্পের সভাপতি মোঃ মান্নান মোল্লা বলেন, এরকম অনিয়মের কথা আমার জানা নেই। যদি অনিয়ম হত এবং কেউ যদি অভিযোগ দিত তাহলে আমি ব্যবস্থা নিতাম। আর যদি এরকম অনিয়ম থেকেই থাকে তাহলে এটি পিআইওর বিষয়। আমি পিআইসি দিয়েছি এবং রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি কাজ করার জন্য। যদি কেউ কাজে না আসে তাহলে অনুপস্থিত দেখাবে। আর কাজে যারা অনুপস্থিত থাকে তাদেরকে টাকা দিবেই বা কেন।

আত্রাই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নভেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটি ঠিক না। চেয়ারম্যান যদি বলেই থাকেন তাহলে ভাল কথা। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে কর্মসূচীতে যাদের নাম আছে তালিকাতো চেয়ারম্যানই দিয়েছেন। আমিতো কাউকে চিনি না। আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, এরকম কোন অভিযোগ আমার জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।

(বিএম/এসপি/নভেম্বর ২৯, ২০১৮)