চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর বিভিন্ন বাজার ও স্টেশনে সিএনজি অটো-রিকশার ড্রাইভারদের কাছ থেকে সমিতির নামে টোকেন কিংবা রশিদে মাসিক ও দৈনিক চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।

এসব সমিতির মধ্যে রয়েছে, চট্টগ্রাম অটো রিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন রেজি নং চট্ট-১৪৪১, কর্ণফুলী থানা অটো রিকশা অটো টেম্পো ও চার ষ্টোক শ্রমিক কল্যাণ বহূমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ রেজি নং-৮৮৮২, কাঞ্চনা ফুলতলা ডলুব্রীজ অটো রিকশা ও সিএনজি মালিক বহুমূখী সমবায় সমিতি লিঃ রেজি নং-১০৬১৭, গ্রাম অটো রিকশা অটো টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন রেজি নং-চট্ট ১৪৪১, ডলুব্রীজ অটো রিকশা সিএনজি মালিক সমবায় সমিতি রেজি নং ৮০১৫ (১৯৯) দৃশ্যমান হয়।

অভিযোগ রয়েছে, এসব সমিতি ও ইউনিয়নের আদায় করা চাঁদার ভাগ যাচ্ছে কর্ণফুলী মইজ্জ্যারটেক মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও স্থানীয় রাজনৈতিক কিছু প্রভাবশালী নেতাদের পকেটে। তাদের ছত্রছায়ায় চলছে এসব আজব সমিতির বেপরোয়া চাঁদাবাজি।

অপরদিকে এ বাণিজ্যে স্থানীয় পুলিশের নীরব ভুমিকা সুযোগ বুঝে কিছু ভুইঁফোড় সংগঠনের নেতারাই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কর্ণফুলী এলাকা কিংবা আনোয়ারা উপজেলায় চলমান প্রতিটি সিএনজি গাড়ির সামনের আয়নায় একাধিক জল রংয়ের স্টিকার। যা সহজে সাধারণ মানুষের চোখে পড়েনা।

কেনোনা অভিনব পদ্ধতিতে তৈরী করা এসব লাল,নীল,সবুজ ও সাদা রংয়ের স্টিকার। একেক মাসে একেক রং। ১২ মাসে বার রংয়ের টোকেন। এছাড়াও অনেক ড্রাইভারের পকেটে থাকে কাগজে টোকেন। যে টোকেনে বিস্তারিত কোন ঠিকানা নেই। থাকে একটি মোবাইল নাম্বার ও ডাক নাম। নয়তো কৌশলগত কারণে নামটিও ভুয়া থাকে।

জানা যায়, টোকেন ও স্টিকারে নতুন ব্রিজের দক্ষিণ পাড় কর্ণফুলী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরাকান মহাসড়ক মইজ্জ্যারটেক থেকে শুরু করে আনোয়ারার শেষ ও পটিয়া থেকে সাতকানিয়া পর্যন্ত প্রতিদিন একাধিক যাত্রীবাহী পরিবহন ও যানবাহন থেকে আদায় করা হচ্ছে নগদ অর্থ।

এছাড়াও যারা কর্ণফুলী ব্যতিত অন্য উপজেলা হতে মইজ্জ্যারটেক মোড়ে যাত্রী নিয়ে আসে। তাদের প্রতিটি সিএনজি হতে ‘চট্টগ্রাম অটো রিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন’ নামক একটি সমিতি রশিদ কেটে চাঁদা আদায় করে ২০ থেকে ৪০টাকা। রশিদে উল্লেখ থাকে ২০ টাকা।

যদি কোন ড্রাইভার মইজ্জ্যারটেকে তা দিতে অস্বীকার করে তবে সে কোন যাত্রী নিতে পারেনা। এ যেন আজব নিয়ম সমিতি ও ইউনিয়নের। ক্ষোভে অনেক সিএনজি ড্রাইভারকে বলতে দেখা যায়, সড়কের মালিক সরকার অথচ খবরদারি করে কথিত সমিতি ও কিছু অসাধু ট্রাফিক পুলিশ ও নাম স্বর্বস সমিতি।

এ ছাড়াও ব্রিজঘাট টু মইজ্জ্যারটেক সিডিএ সড়ক দখল করে সরু করে রেখেছে অনেক দোকানদার। এমনকি মহাসড়কে চলাচল করতে না দেওয়ায় বিভিন্ন সংযোগ সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকেও এক শ্রেণীর জনপ্রতিনিধিরা চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ। স্থানীয় পুলিশ তাগাদা দিলেও শুনছেনা।

উপজেলার প্রতিটি বাজারে মূলত রাতের আধারে সরকারি বিদ্যুৎ লাইন হতে অবৈধ সংযোগ দিয়ে গ্যারেজ মালিকেরা অটো রিকশায় চার্জ করাচ্ছে বলেও রয়েছে অভিযোগ। আর এসব ব্যাটারী চালিত রিকশার ব্যাটারিতে চার্জ করার নামেও প্রতারণাপুর্বক মাসিক হারে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। যেন দেখার কেহ নেই।

ভোক্তভোগি সিএনজি ড্রাইভারদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী তাদের চাঁদার পরিমাণ দৈনিক ১৫/২০ টাকা, মাসিক ১০০/২০০ ও ২৫০ টাকা। কর্ণফুলীতে ‘চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন’ এর অধীনে ৭শ মতো বেশি সিএনজি ও কর্ণফুলী থানা অটো রিকশা অটো টেম্পো ও চার ষ্টোক শ্রমিক কল্যাণ বহূমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ এর রয়েছে ১২শ’র মতো সদস্য। তাহলে ভিন্ন হিসাবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০হাজার টাকা, মাসে ৬ লাখের উপরে এবং বছরে আনুমানিক ৭২ লাখ টাকা শুধু পরিবহন খাত থেকেই আদায় করা হয়।

এ টাকা যাচ্ছে কার পকেটে? এ চাঁদাবাজি রুখবে কে! এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মইজ্জ্যারটেক ও ব্রিজঘাটে সিএনজি এসে দাড়ানোর আগেই রশিদ কেটে ল্যাইনম্যান জকির হাজির। তার দেওয়া ১৫টাকার রশিদে লেখা ল্যাইনমান ৫,এক্সিডেন্ট ফান্ড ৩,মৃত্যু ফান্ড ৭ মোট ১৫টাকা। নিচে সভাপতি সম্পাদক এর ছাপা স্বাক্ষর। চোখে পড়ার মতো একটি লাইন ও নজর কাড়ে “ধন্যবাদের সহিত গৃহীত হইল”এ যেন রমরমা চাঁদাবাজির নানা চিত্র।

তথ্য পাওয়া যায়, মইজ্জ্যারটেক মোড়ে প্রতিদিন ও মাসিক হারে চাঁদা আদায় করে মোঃ ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি। তার দেওয়া ছাপা রশিদে দেখা যায় ল্যাইনমান ৫,এক্সিডেন্ট ফান্ড ৩,মৃত্যু ফান্ড ৩, কল্যাণ ফান্ড ৪ মোট ১৫টাকা। অভিনব চাঁদাবজি। তার পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে কোন ড্রাইভার সাহস করেনা বলতে।

এছাড়াও আনোয়ারা উপজেলার চাতুরী চৌমুহনী মোড়ে টোকেন এ চাঁদা তুলেন আবু ছালেক ও রাশেদ নামে দুই ব্যক্তি। এরা যে টোকেন দেয় তাতে দেখা যায়, মাসের নাম ও সিরিয়াল লিখা প্রিন্ট করা কাগজ। পাশে কলমে লেখা একেক টোকেনে একেক মুঠোফোন নাম্বার ০১৮৬৪১৪৯৯০৩, ০১৮৬৭৫৪১৮১৪। কিছু টোকেনে নামের জায়গায় ভাই ভাই।

লক্ষ্য করা যায়, প্রতিটি টোকেনের অপরপাশে আবু ছালেক ও রাশেদ নামে দুব্যক্তির স্বাক্ষর। উল্লেখিত মুঠোফোনে তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে সাংবাদিক পরিচয় পেতেই রং নাম্বার বলে লাইন কেটে দেন কয়েকবার।

নাম প্রকাশ না করা চট্টগ্রাম থ-১৪ সিরিয়ালের এক সিএনজি চালক বলেন, ‘টাকা না দিলে পার্কিং করা তো দূরের কথা, মইজ্জ্যারটেক রাস্তার পাশে যাত্রী নামাতেও বাধা দেয় ইউসুফ । মারধর করে তাড়িয়ে দেয়।

তিনি আরো বলেন, গাড়ির সব কাগজ ৪বছর ধরে ঠিক থাকলেও ট্রাফিক পুলিশ কখনো তা চায়নি বরং প্রথমেই তারা ইউনিয়ন ও সমবায় সমিতির দেওয়া স্টিকার ও টোকেন আছে কিনা জানতে চান বলে মন্তব্য করেন উক্ত ড্রাইভার।

তবে কি! ট্রাফিক পুলিশের সাথে এসব সমিতির একটি অদৃশ্য যোগসুত্র রয়েছে? নাহয় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব ছিলো গাড়ির লাইসেন্স দেখা, সমিতির টোকেন বা স্টিকার নয়?

অনেক ড্রাইভারেরা জানান, সমিতির দেওয়া ১০০ টাকার স্টিকার গুলো মূলত সমিতির নয় বরং এসব স্টিকারের মালিক ট্রাফিক পুলিশ। তারাই সমিতির কাছে এসব স্টিকার বিক্রি করেন। যদিও তা কতটা সত্য এখনো তা প্রমাণ জানা যায় নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘চট্টগ্রাম অটো রিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন’ এর সভাপতি মোঃ হানিফ বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের নিয়মে রয়েছে রশিদ দিয়ে টাকা তোলার তাই ল্যানম্যানের খরচ ও সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব চালকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের জন্য ফান্ডে কিছু মাসিক চাঁদা নেওয়া হয়।’

জিজ্ঞেস করার পরও তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেলেন দৈনিক হারে চাঁদা তোলার বিষয়টি। এড়িয়ে গেলেন কোন ফান্ডে কোন ব্যাংকে উত্তেলিত টাকা জমা রাখেন সে বিষয়ও।

এমনকি লাখ লাখ উঠানো টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয় জানতে চাইলে সভাপতি হানিফ জানান, তিন মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার শিকলবাহার মোঃ ইলিয়াছ ড্রাইভার’কে ১০ হাজার টাকার সহযোগিতা করেছেন বলে তথ্য দেন।

অনেক সময় মাঝে মধ্যে উর্ধ্বতন প্রশাসন কিংবা সরকারের নানা চাপে সড়কে প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় বন্ধ করা হলেও কিছুদিন পরে চাঁদা আদায় শুরু হয় পুনরায়। যেন যে লাই সে কদু, যা বায়ান্ন তা তেপান্ন।

অপর একটি সমিতি রশিদে ১৫ টাকা ও স্টিকারে মাসিক ১০০ টাকা আদায় করে কি করেন এসব টাকা এমন প্রশ্নে কর্ণফুলী থানা অটো রিকশা অটো টেম্পো ও চার ষ্টোক শ্রমিক কল্যাণ বহূমুখী সমবায় মালিক সমিতি লিঃ এর সভাপতি মোঃ আবু বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের সাথে আমাদের একটা কথা হয়েছে। লাইনম্যান ও এক্সিডেন্ট ফান্ড এর জন্য আমরা কিছু টাকা তুলি বিপদে ড্রাইভারদের সাহায্য করি।’

এ পর্যন্ত কাকে সাহায্য করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনিও শিকলবাহার ইলিয়াছ ড্রাইভারকে ২৩ হাজার টাকার সহযোগিতা করেছেন বলে জানান। তবে আর্শ্চয্যের বিষয় অন্য সমিতির সভাপতি হানিফ ও একই ব্যক্তিকে সাহায্য করেছে বলে তথ্য দেন।’ আরো কিছু তথ্য জানতে চাইলে আর কিছু বলতে পারবনা বলে লাইন কেটে দেন তিনি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মইজ্জ্যারটেক ট্রাফিক পুলিশ বক্সের ( ট্রাফিক ইনচার্জ) টিআই মোঃ মোস্তফা মামুন সবৈর্ব অস্বীকার করে বলেন, ‘টোকেনে বা রশিদে যারা টাকা আদায় করে তারা সমিতির লোক ট্রাফিকের কেউ নয়। মইজ্জ্যারটেক ট্রাফিক বক্সে আমি আসার পর হতে কোন ধরনের অটো রিকশা ও ফোর স্টোক সমিতি হতে অবৈধ সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করা হয়না বরং আইন মেনেই সব চলছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ সামশুল তাবরীজ বলেন,‘যাত্রী হয়রানি ও ড্রাইভারদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে নানা অভিযোগ পেয়েছি এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

(জেজে/এসপি/ডিসেম্বর ০১, ২০১৮)