প্রবীর সিকদার


কয়েকদিন ধরেই আমি আমাদের দেশের আমলাদের নিয়ে ভাবছি। 'আইনে অবিচল' আমলাদের সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল আমারই দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় হারাধনের কথা! আমার সেই শিশুকালে শোনা কৌতুক উদ্রেককারী হারাধনের গল্পটি দেশের সেরা মেধাবী আমলাদের মূল্যায়নে এভাবে কাজে লেগে যাবে ভাবিনি কখনো! কি আর করা! প্রিয় পাঠকদের মনোরঞ্জন করতেই না হয় সেই হারিয়ে যাওয়া হারাধনকে আর একবার জীবন ফিরিয়ে দেই!

গ্রামের এক ছোট ব্যবসায়ী পরিবারের হাবাগোবা ছেলে হারাধন। এই হাবাগোবা ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় চিন্তিত বাবা-মা। আত্মীয় স্বজন ও গ্রামের সবাই পরামর্শ দিলেন গরীব কোনো পরিবারের মেয়ে খুঁজে হারাধনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার। বিয়ে দিলেই নাকি সেরে যাবে হাবাগোবা ভাবটা!

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। দূর গ্রামের মেয়ে আশালতার সাথে বিয়ে দেওয়া হল হারাধনের। বিয়ের পর হাবাগোবা হারাধনকে নিয়ে বড় বিচলিত হয়ে পড়ল আশালতা। কী আর করা, হিন্দু মতে বিয়ে বলে কথা! ভাগ্যের লিখন হিসেবেই মেনে নিল আশালতা।

জীবন চলবে কিভাবে, এই ভাবনায় অস্থির আশালতা আয়-রোজগারের পথ খুঁজতে লাগলো। খুঁজেও বের করল একটি পথ; ধান কিনে সিদ্ধ শুকনো করে ঢেঁকিছাঁটা চালের ব্যবসা! আশালতা গ্রামের বাড়ি বাড়ি থেকে ধান কিনে সিদ্ধ শুকনো করে ঢেঁকিতে ছাঁটাই করে। পরে এক সকালে স্বামী হারাধনকে দাঁড়িপাল্লায় মাপঝোঁক শিখিয়ে বেতের ধামায় চাল ও দাঁড়িপাল্লা বাটখারা সাজিয়ে স্বামীকে বাজারে পাঠায় বিক্রি করতে। সেই সাথে আশালতা শিখিয়ে দেয় ১০টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করতে। ঘাড় নেড়ে সায় দেয় হারাধন।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয় তবু হারাধন বাড়ি ফিরছে না দেখে অস্থির আশালতা পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক সময় হারাধন ফেরে। চাল বিক্রি করে ফিরেছে এই ভাবনায় বেশ খুশি মনে মাথা থেকে ধামা নামাতেই আশালতা টের পায় চাল বিক্রি হয়নি। কেন বিক্রি করনি জিজ্ঞেস করতেই হারাধন জানায়, বাজারে চালের কেজি সাড়ে ৯ টাকা এবং পৌনে ১০ টাকা। কেউ ১০ টাকা কেজি দরে চাল কিনতে চায়নি, তাই ফেরত নিয়ে এসেছে।

পরেরদিন আশালতা আবার ওই চালের ধামা স্বামীর মাথায় তুলে দিয়ে বাজারে পাঠায় বিক্রি করতে। এবার সে শিখিয়ে দেয় সাড়ে ৯ টাকা কিংবা পৌনে ১০ টাকা দরে যেন সে চাল বিক্রি করে দেয়। আবার সায় দেয় হারাধন।

আবার সেই প্রতীক্ষা সন্ধ্যা অব্দি গড়ায়। সন্ধায় হারাধন ফিরে এলে আশালতার আশাভঙ্গ হয় আগের দিনের মতোই! এবার হারাধন জানায়, বাজারে চালের দাম ১০ টাকা এবং সোয়া ১০ টাকা হওয়ায় সে চাল বিক্রি না করেই ফিরে এসেছে!

তারপর আর স্বামী হারাধন নয়, চালের ধামা নিয়ে আশালতা নিয়মিত বাজারে যায়; আর এভাবেই চলে আশালতার বাঁচার লড়াই।

আমাদের আমলারা তো এক একজন হারাধন! হারাধনের সম্বল বউয়ের শেখানো বুলি, আর আমলাদের মগজে কাগুজে আইন! বউয়ের শেখানো বুলিই হোক, কিংবা হোক কাগুজে আইন; এর বাইরে যে যাওয়ার মগজ নেই কারোরই; তিনি আমলা কিংবা হারাধন যেই হোক!