গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : পিতৃহীন দরিদ্র মাতার সংসারে অভাব-অনটনে পড়ে স্কুল শিক্ষার্থী ইভা আক্তারের ভবিষ্যত পড়াশোনা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইভা গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে। তবে পরীক্ষার ফি’র সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে না পারায় গত রোববার পরীক্ষার হলে সহপাঠীদের সামনে তাকে কটূক্তি করে অপমান করেন বিদ্যালয়ের এক সহকারি শিক্ষক। বিষয়টি জানজানি হলে স্থানীয় সাংবাদিক ও ইউএনও’র হস্তক্ষেপে তার পরীক্ষার ফি মওকুফ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে আগামী বছর কিভাবে পড়াশোনা চালাবে সেই শংকায় রয়েছে তার মা ও বোন। তবে কি ইভার পড়াশোনা এখানেই বন্ধ হয়ে যাবে?

ইভার বাড়ি গৌরীপুর পৌর শহরের মাঝিপাড়া এলাকায়। তার বাবার নাম ইয়ার হোসেন। মায়ের নাম নূর নাহার। তিন ভাই-বোনের মধ্যে ইভা সবার ছোট।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ইভা যখন মায়ের গর্ভে তখন তার বাবা তাদের ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যান। এরপর বেঁচে থাকার তাগিদে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে মা নূরনাহার অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেয়। ইভা যখন প্রাথমিকে পড়ে তখন ঘোষপাড়া এলাকায় সড়কের পাশে একটি চায়ের দোকান দেন তার মা নূর নাহার। দোকানের ওই আয়ের টাকা দিয়েই চলতো তাদের চার সদস্যের সংসার ও দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ।

চলতি বছর বিদ্যালয়ে বেতন, পরীক্ষার ফি ও জরিমানা সহ অনান্য ফি বাবদ নয়শত টাকা বকেয়া জমে ইভার। কিন্তু ইভার মা ধার-দেনা করে বিদ্যালয়ে পাঁচশত টাকা জমা দেন। গত রোববার বিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে সহকারি শিক্ষক নাজিরুল ইসলাম ইভাকে বকেয়া টাকার জন্য চাপ দেন। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষক পরীক্ষার হলে খাতা রেখে ইভাকে বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দেন। এবং ইভাকে উদ্দেশ্য করে বলেন ‘পরীক্ষা রেখে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আয়, তোকে দশ মিনিট সময় বাড়িয়ে দিবো’। পরীক্ষা শেষে ইভা বাড়ি ফিরে তার মাকে ঘটনা খোলে বললে বিষয়টি জানাজানি হয়। পরে সাংবাদিক ও ইউএনও’র সুপারিশে পরীক্ষার ফি মওকুফ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

মঙ্গলবার দুপুরে ইভার দেখা মিলে তার মায়ের চায়ের দোকানে। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় দোকানে তার মাকে সাহায্য করছিল ইভা।

ইভার মা নূর নাহার বলেন, পরীক্ষার ফিসের লেইগ্যা ইভারে ইসকুলে কথা কইছে। মাইয়্যাডা বাড়িত আইয়্যা কান্দাকাডি শুরু করছে। কিন্তু চা দোকানদারি কইর‌্যা যে টাকা কামাই করি সেটা দিয়া তো তিনলো ভাত খাইতে পারিনা। পোলাপানের লেহাপড়ার খরচ যোগামু কেমনে।

ইভা বলেন, ওইদিন স্কুলে নাজিরুল স্যারটাকার জন্য চাপ দিলেও শেষ পরীক্ষায় আর কিছু বলেনি। ২২ তারিখ আমার রেজাল্ট হবে। কিন্তু মা বলে গরিবের মেয়ের পড়াশোনার দরকার নেই। আর পড়াশোনা করালে এতো টাকা পাবো কোথায়। টাকার অভাবে কি আমার পড়াশোনার বন্ধ হয়ে যাবে? আমি তো পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার হতে চাই।

ইভার বড় বোন ইমু আক্তার জানিয়েছে, এবছর না হয় চলে গেছে। আগামী বছর কিভাবে কি হবে? পুরো সংসারটা মায়ের উপার্জনে চলে।

গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান ফকির বলেন, ইভারা দুইবোন ভাল ছাত্রী। বড়বোন ইমু এসএসসিতে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন) পেয়েছে। বকেয়া ফির জন্য পরীক্ষার হলে ইভাকে অপমান করা ঠিক হয়নি। এতে শিশুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কিছুদিন আগে ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে অপমানের জের ধরে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। শিক্ষকদের এই বিষয়গুলো একটু মাথায় রাখা দরকার বলে মনে করছি।

জানতে চাইলে গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এনামূল হক সরকার বলেন, ইভার পরীক্ষার ফি ও বকেয়া নিয়ে যে জটিলতা হয়েছিলো সাংবাদিকরা বিষয়টি আমাকে অবগত করার পর সেটা সমাধান করা হয়েছে। তার পরিবার আবেদন করলে বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।

(এসআইএম/এসপি/ডিসেম্বর ১১, ২০১৮)