রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : বাংলাদেশের দলিত জনগোষ্ঠী ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবগুলোকে নিজেদের উৎসব হিসেবে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যদিও নিরাপত্তার কারণে বৃহৎ আকারের সার্বজনীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পুলিশ বেষ্টনীর মধ্য দিয়েই সম্পন্ন করতে হয়।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার বরাত গ্রামের মানবাধিকার কর্মী চায়না দাস জানান, হিন্দু জনগোষ্ঠী থেকে পিছিয়ে পড়া একটি শ্রেণীর নাম দলিত। তাই হিন্দুদের উদযাপিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো একইসাথে একইভাবে দলিতরা পালন করে থাকে। সে ক্ষেত্রে শারদীয় দুর্গোৎসবই দলিতদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এ ছাড়া শ্যামা কালী পুজা, জগদ্ধাত্রী পুজা, সরস্বতী পুজা, ব্রহ্মা পুজা, বনবিবি পুজা, বাসন্তী পুজা, লক্ষী পুজা, চড়ক পুজা সবই সবই তারা পালন করে থাকেন। এক সময় দলিত জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বা অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজন।

কালের বিবর্তনে সে অবস্থা ক্রমশঃ পরিবর্তিত হচ্ছে। দলিত জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়াসহ সরকারি ও বেসরকারি চাকুরিতে দলিতদের অংশ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় হিন্দু সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি পুজা পার্বনে বৈষম্যের স্বীকার হলে দলিতদের প্রতিবাদ উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের আচরণ কিছুটা হলেও নমনীয় হতে হচ্ছে।

চায়না দাস আরো বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীন পরবর্তী বাংলাদেশে হিন্দু সমনপ্রদায়ের সাথে সাথে দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও ক্রমশঃ কমতে শুরু করে। বর্তমানে এ দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ বলে সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়। যদিও বাস্তবে তার সংখ্যা অনেক কম। ভোটার তালিকায় অনেকের নাম থাকলেও ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা কেটে ছিড়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা, শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তির নামে জমি জবরদখল, নিরাপত্তার অভাব, মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত, মিথ্যা মামলায় হয়রানি, ন্যয় বিচার না পাওয়া, ধর্মান্তরকরণসহ বিভিন্ন কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্রমশঃ দেশ ত্যাগ করায় আগামি কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হিন্দু বা দলিত জনগোষ্ঠী বর্জিত একটি দেশে পরিণত হবে। সংখ্যাগুরুদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের কাল্পনিক ধুয়ো তুলে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রতিমা ভাঙচুর, লুটপাঠ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো এতটাই হৃদয় বিদারক যে হিন্দুরা এ দেশে বসবাাসের মানসিকতা হারিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।

এসব অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনায় যখন রাজাকার আলবদরদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা অংশ নেন তখন কথা বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেলতে হয়। চাঞ্চল্যকর এসব ঘটনায় যখন থানায় মামলা হয় সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অব্যহতি পাওয়া নেতাদের আরো বেশি অত্যাচারি হতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি গৌর পদ দাস বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বিএনপি-জামায়ত সমর্থিত চার দলীয় জোট, আাওয়ামী লীগ সমর্থিত মহাজোট বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এদেশের গণতন্ত্রের মুল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে সংবিধান কাটা ছেড়া করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ২০০৮ সালের নবম সংসদীয় নির্বাচনের নির্বাচনী ইস্তেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবে বলে ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরবর্তী ২০১৪ সালে আরো একবার মহাজোট ক্ষমতায় গেলেও বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি স্থান পায়নি। হয়তো বা মুসলিম মৌলবাদিদের ভোট হারানোর ভয়ে সে কাজটি করতে পারেননি সরকার প্রধান।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য গোষ্ট বিহারী মণ্ডল বলেন, এদেশের দলিত তথা সংখ্যালঘুরা ঐক্যবদ্ধ না হওয়ায় তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন সংখ্যালঘুদের সম্পদ লুটপাঠ, জবরদখল, হামলা, মামলা অব্যহত রয়েছে। কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের মুকুন্দ মধুসুধনপুর চৌমুহুনীর দলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য নীলু সরকার ও তার পরিবারের সদস্যদের জমি জবরদখল করতে আওয়ামী লীগ নেতা ও মানবাধিকার কর্মী মোসলেম আলী হত্যাকাণ্ডের নায়ক শ্রীরামপুর গ্রামের গহর আলী মোড়লের ছেলে বিএনপি কর্মী রুহুল আমিন মোড়ল ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী যেভাবে পরিকল্পিত মামলা দিয়ে পুলিশের সহায়তায় তাদের হয়রানি করছে তা নজির বিহীন।

তাছাড়া এ জেলার অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে ভাল ভূমিকা না রেখে নির্যাতনকারিদের দারা প্রভাবিত হওয়ায় সংখ্যালঘুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়াও সংখ্যালঘুদের দায়েরকৃত মামলা ও অভিযোগগুলোর যথাযথ তদন্ত না করে বা প্রভাবিত হয়ে তদন্ত করায় অনেকাংশে ন্যয় বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। আবার প্রশাসনের সহযোগিতা পেতে উৎকোচ দিতে দিতে নিঃস্ব হতে হচ্ছে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দদের নিয়ে প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাাদি যথাযথভাবে পালনের নিশ্চয়তা দিলেও মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের মত ঘটনা ঘটছেই। মনষা পুজা উপলক্ষে শহরের গুড়পুকুর মেলায় বোমা হামলা, কালিগঞ্জের ফতেপুর ও চাকদাহে সহিংসতা, শহরের ঝুটিতলায় নামযজ্ঞ চলাকালে হামলা, দেবহাটার সুবর্ণাবাদে কালি প্রতিমা ভাঙচুর, সদরের বাবুলিয়া, আশাশুনির কচুয়া ও কল্যাণপুরে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর, সর্বপরি ঝাউডাঙার ওয়ারিয়া গ্রামে রাধা গোবিন্দ মন্দিরে প্রতিমায় অগ্নিসংযোগসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা শাস্তি না পাওয়ায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো স্বাভাবিকভাবে পালন করতে তারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।

(আরকে/এসপি/ডিসেম্বর ২২, ২০১৮)