১৯৯১ সাল। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। দিন-তারিখ সঠিক মনে নেই। স্কুলের টিফিনের সময় যেই শিবচর বাজারে ঢুকছি দেখলাম ‘সাগর ভদ্র’র ঔষধের দোকানের সামনে কিসের যেন একটা জটলা। অনেকটা কৌতুহল নিয়ে গিয়ে দেখি অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত সদ্য কৈশোর পেরোনো এক যুবক; মূলত জটলাটা তাকে ঘিরেই।

পরে জানলাম ওনিই হচ্ছেন আমাদের তখনকার সময়ের সদ্য প্রায়ত সংসদ সদস্য ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী সাহেবের বড় ছেলে লিটন চৌধুরী। বাবার অবর্তমানে উপনির্বাচনের প্রাথী হবেন-এ কারনে বাজারের সব দোকানদার ও সাধারণ মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে একজন নেতা হিসেবে-এই প্রথম তার শিবচরে আগমন। সেদিন স্কুল বাদ দিয়ে ওনার পিছনে পিছনে অনেকটা পথ হেঁটেছিলাম। অন্য কোন কারনে না- এই ভেবে যে ওনি সদ্য ওনার বাবাকে হারিয়েছেন। তখন ওনার প্রতি ক্যামন যেন একটা মায়া কাজ করছিল। ঐ বয়সে আমি তখন আবার মনে মনে এটাও ভাবছিতাম যে এরতো অনেক অল্প বয়স; কিভাবে সংসদ সদস্যেরমতো এত বড় দায়িত্ব পালন করবেন ! ঠিকেই ওই উপনির্বাচনের শিবচরবাসী লিটন চৌধুরীকে সর্ব কনিষ্ঠ সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠান । শিবচরবাসী তার উপর আস্থা রাখতে পেরেছিলেন । তার প্রতিদানও তিনি শিবচরবাসীকে দিয়েছেন। উপনির্বাচনে জয়ের পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধু সামনের দিকেই এগিয়ে গাছেন বীরদর্পে । যতই তাকে দেখছি মুগ্ধতা যেন বেড়েই চলছে। চোখের সামনেই একজন অতিসাধারণ নেতাকে আসাধারন জননেতা হয়ে উঠতে দেখলাম।
এক সময় আমাদের শিবচর ছিল একটি চরম অবহেলিত জনপদের নাম; সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা। একটা উদাহারন দিলেই সবার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে-রাজধানী ঢাকা থেকে শিবচরের দূরত্ব মাত্র ৭০ কিলোমিটার। কিন্তু এই পথ পারিদিতে একসময় আমাদের দুইদিন সময় লেগে যেত। তখনকারদিনে ঢাকায় যেতে হলে টিফিন ক্যরিয়ারে খাবার নিয়ে নৌকায় করে জাজিরার গোপালপুর লঞ্চঘাটে বসে থাকতে হতো অনেকটা সময় । মাদারীপুর সদর থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চ আমাদের আমাদের উঠিয়ে নিতো। লঞ্চেই রাতের খাবার খেয়ে চাদর বিছিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। পরের দিন সকাল বেলা লঞ্চ সদর ঘাটে পৌঁছত। অবহেলিত জনপদ শিবচরে তখন কোন রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কাল্ভারট বলতে কিছুই ছিলনা। তখনকার দিনে যোগাযোগের একমাত্র বাহন ছিল-নৌকা। এমনকি পাশের গ্রামে যেতে হলেও নৌকায় যেতে হতো । সেইসব দিনের কথা ভাবলে এখন অনেকটাই স্বপ্নের মতোই মনে হয়।
অল্প সময়ের ব্যবধানে আজকের শিবচর অনেকটাই রুচিশীল আধুনিক নগরী। এটা ভাবলেও আজ আবার স্বপ্নের মতোই মনে হয়। এই শিবচরকে নিয়ে আমার গর্বের শেষ নেই। শিবচরের সন্তান পরিচয় দিতে আজ আমার অনেক গর্ব হয়। একজন নেতার স্বদিচ্ছা থাকলেই যে একটা এলাকাকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারে-যার একামাত্র উদাহারন আমাদের সংসদ সদস্য নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। এই আধুনিক শিবচরের তিনিই একমাত্র স্থপতি। একজন শিল্পী যেমন নিজের কল্পনাকে তুলির আঁচরে বাস্তবে রূপদেন ঠিক তেমন করেই আমাদের নেতা শিবচরকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন ধীরে ধীরে তার বাস্তবরূপ আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। জীবনের সঠিক প্লানিং থাকলে যেমন সফলতা পাওয়া যায় ঠিক তেমনি এলাকার উন্নয়নের ক্ষেত্রেও দরকার হয় সঠিক কর্মপরিকল্পনা।আমার ধারনা এই মূলমন্ত্রটি তিনি সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যা তার কর্মকাণ্ডগুলো একটু বিশ্লেষণ করেলেই দেখা যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে শিবচরবাসী উন্নয়নের ছোঁয়া পেতে শুরু করে। তিনি প্রথমেই যে কাজটা করেন তা হচ্ছে উপজেলা সদরের সাথে ইউনিয়নগুলোর সংযোগ সড়ক। রাস্তা না থাকলেও সমস্ত নদী বা খালের উপর ব্রিজ-কাল্ভারট নির্মাণ করেন। মানুষজন তখন ভুল বুঝলেও এখন ঠিকেই তার বুঝতে পেরেছে - এটা ছিল কতটা পরিকল্পিত। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসলে শিবচরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আবার থেমে যায়। পরিকল্পিত ভাবেই শিবচরবাসীকে বঞ্চিত করা হয়। সংস্কারের অভাবে রাস্তাগুলো একেকটা স্তুবে পরিণত হয়। এখনও সেইদিনগুলোর কথা মনে পড়েলে গা সিউরে উঠে । বিশেষ করে পাচ্চর থেকে শিবচরের রাস্তার কথা মনে পড়লে তখন আর দেশের বাড়িতে মানে শিবচরে যেতে ইচ্ছে করতোনা।
২০০৮ সালে আবার আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে এমপি মহোদয় তার পরিকল্পনার অসমাপ্ত কাজে হাত দেন। বিগত দশ বছরে তিনি শিবচরকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। আর এটি সম্ভব হয়েছে কেবল মাত্র তার দূরদর্শী কর্ম পরিকল্পনা আর লেগে থাকার কারনে। প্রসঙ্গক্রমে ক্রমে একটি কথা বলতে চাই। ২০১৫ সালে বেতন বৈষম্য নিয়ে পেশাজীবীদের একটা আন্দোলনে আইইবি-তে ছিলাম। আমার সাথে তখন শিবচরের উপজেলা প্রকৌশলী ছিল। ওনাকে বারাবার ফোন নিয়ে বাইরে যেতে দেখি । আমি কিছুটা বিরক্ত নিয়েই ওনাকে জিজ্ঞেস করি- কে এতবার ফোন করছে আপনাকে? ফোন বন্ধ করে রাখুন!তখন প্রকৌশলী আমাকে বললেন “এম পি মহোদয়”। আমাকে বললেন –শিবচরের প্রতিটা রাস্তা-ঘাট ওনার নখ-দর্পণে। কোথায় কতটুকু কাজ হচ্ছে সব নিজেই মনিটরিং করেন। আমকেও চাকরীর সুত্রে অনেক সাংসদের সাথে কাজ করতে হয় কিন্তু এরকম অবস্থার সম্মুখীন কখনো হতে হয়নি। এখন মনেহচ্ছে হলে খুবেই ভালো হতো। অনেকটাই অনুধাবন করলাম শিবচরের উন্নয়নের পেছনের রহস্য। আমার ধারনা বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে বাস্তবায়নাধীন অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পের সকল তথ্য এম পি মহোদয়ের জানা। খুঁজে খুঁজে উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দগুলো শিবচরে জন্য নিয়ে আসেন।
তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে যেসব কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হাজার কিলমিটার অভ্যন্তরীন সড়ক, দুই-শতাধিক প্রাথমিক ও স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ভবন, উপজেলা পর্যায়ে দেশের প্রথম হাউজিং প্রকল্প, চারটি থানা তদন্ত কেন্দ্র, চারটি কলেজকে অনার্স ও একটি কলেজে মাস্টার্স কোর্স চালু, আধুনিক তিনটি অডিটেরিয়াম, মুক্ত মঞ্চ, শিল্পকলা একাডেমী, সুপার মার্কেট, আধুনিক বাস স্ট্যান্ড, শিশু পার্ক ইত্যাদি ইত্যাদি। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামীতে শিবচর হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ নগরী। সে লক্ষে বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে যেমন আইসিটি ইনস্টিটউট এন্ড হাইটেক পার্ক, বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত আইসিটি ইনস্টিটউট, নার্সিং ইনস্টিটউট, জুট ইনস্টিটউট, তাত পল্লী, ট্রমা সেন্টার ইত্যদি। আমার বিশ্বাস আগামী মেয়াদে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে এগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হবে।
মুক্তিযুদ্ধ- আমাদের গৌরব আমাদের অহংকার- ইতিহাসের গৌরবময় সোনালী অধ্যায়। যেখান থেকে আমার প্রত্যকেই দেশের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা পাই। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে শিবচর হতে পারে একটা প্রকৃষ্ট উদাহারন। উপজেলা শহরে ঢুকলেই মনে হবে- এটি যেন একাটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত জাদুঘর। এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত অসংখ্য মুর‍্যাল, ভাস্কর্য- যার প্রত্যকটিই যুদ্ধকালীন বিভিন্ন ইতিহাস বহন করে। আর এ সবের অনেকগুলোই করেছেন সংসদ সদস্য মহোদয় তার নিজস্ব তহবিল থেকে। স্কুলে স্কুলে বঙ্গবন্ধুর মুর‍্যাল স্থাপনসহ বিভিন্ন ভবন ও রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে। শহরের মার্কেটগুলোকে মোড়ানো হয়েছে লাল-সবুজে।আমার বিশ্বাস তার এই মহান উদ্যোগের কারনেই নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।
পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্যই শিবচর আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। লিটন চৌধুরীর উন্নয়ন চিত্র দেখতে অনেক সংসদ সদস্য ও বিভিন্নদলের রাজনীতিবিদেরও শিবচরে ভ্রমণ করতে দেখেছি । আবার এদের কাউকে কাউকে বলতে শুনা গেছে “আমারা সংসদরা শিবচরে শিক্ষা সফরে এসেছি। আমারা লিটন চৌধুরীর কাছ থেকে পরিকল্পিত উন্নয়ন, মুক্তি যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও মানুষকে কিভাবে ভালবাসতে হয় তা শিখে গেলাম। এই অভিজ্ঞতা আমারা আমাদের নির্বাচনী এলাকায় কাজে লাগাবো” । একথা বলতে আমার আর কোন দ্বিধা নেই যে, মাদারীপুর-১(শিবচর) আসনটি হতে পারে রাজনীতির পাঠশালা, লিটন চৌধুরী যেখানে প্রধান শিক্ষক। এখান থেকে রাজনীতিবিদরা উন্নয়নের মন্ত্র নিতে পারেন।
এক জন নেতা হওয়ার প্রথম ও প্রধান গুনটাই হলো একজন ভালো মানুষ হওয়া। দেশ ও জনগণের প্রতি থাকবে নেতার আফুরন্ত ভালবাসা। আর এটি এমনি এমনি হয়না। এর জন্য দরকার হয় ব্যক্তির পারিবারিক ঐতিহ্য, তার বেরে ওঠা সর্বোপরি মনস্তাত্ত্বিকবোধ ও অনুশীলন । সে বিচারে লিটন চৌধুরী শৈশব –কিশোর –যৌবন কেটেছে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে । দেশের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণাটা তিনি পেয়েছিলেন নিজের পরিবার থেকেই। তার বাবা মরহুম ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ছিলেন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর বড় ভাগ্নে, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক , মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ, সাবেক সংসদ ও গণপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও সমাজ সেবক। আর দেশ সেবার এ মন্ত্রটা লিটন চৌধুরী পেয়েছেন ওনার বাবার কাছ থেকেই।
আমরা জানি যে নেতা ‘কর্মীবান্ধব’, যিনি কর্মীদের সুখে দুঃখে নিজেকে সপে দেন, তিনিই দলের আদর্শ নেতা। সে বিচারে লিটন চৌধুরী অনেক বেশি কর্মীবান্ধব। নেতাকর্মীদের একমাত্র ভরসার স্থান। তার নেতৃত্বে শুধুমাত্র দলনা –সমস্ত এলাকাটাই ঐক্যবদ্ধ। বরাবরেই শিবচরের আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক ভাবে অনেক শক্তিশালী। লিটন চৌধুরী সংসদ সদস্য হওয়ার পর এটি এখন অনেক বেশি শক্তিশালী । এখানে আওয়ামীলীগসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের রয়েছে পুরনাঙ্গ কমিটি- যার বিস্তৃতি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায় রয়েছে। দলের রাজনীতিতে রয়েছে তার কঠিন নিয়ন্ত্রন।
পরিশেষে আমি একটি কথাই বলতে চাই -ছলে বলে কৌশলে দল বা সকারের উচ্চ পদ বাগিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু কর্মী সাধারনের মন পাওয়া যায়না। সততা আর দেশপ্রেম দিয়েই সাধারনের নেতা হতে হয়। রকমারি টিভি ক্যামেরার সামনে ঝকমারি কথাদিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য গণমাধ্যমের হিরো হওয়া যায়, কিন্তু গন মানুষের নয়নের মনি হওয়া যায়না। একজন সত্যকারের নেতাকে দেখলে এই যুগেও রাজনীতির প্রতি মানুষে আগ্রহ জন্মে। মানুষের মধ্যে রাজনীতিমুখতা তৈরি হয়। অন্তর থেকেই নেতার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়।

মোঃ কামরুজ্জামান মিলন
পিএইচডি গবেষক, গিয়ানসাং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া
ইমেইলঃ [email protected]