সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা


একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ৩০ ডিসেম্বর। এ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিশাল জয়ে দায়িত্বও বেড়েছে অনেক। বৃহস্পতিবার নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যগণের শপথবাক্য পাঠ করালেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। এরপর আওয়ামীলীগের সংসদীয় অধিবেশনে টানা তিনবারের সংসদ নেতা নির্বাচিত হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর জয়যাত্রা শুভ হোক এ কামনা করি সমগ্র দেশবাসীর পক্ষ থেকে।

তবে পাশাপাশি আশা করছি এ বিশাল জয়ের মধ্যে সরকারকে শক্তিশালী বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করতে হবে এই আওয়ামীলীগের ভেতর থেকেই। আমি নামিদামি কোন লেখক নই, দৈনিক সমকাল পত্রিকার কেন্দুয়া উপজেলার প্রতিনিধিসহ স্থানীয় বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও উত্তরাধিকার ৭১ অনলাইন পত্রিকার নিয়মিত সংবাদ পরিবেশ করে থাকি। আমার পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে যতটুকু জানি এবং বুঝি এর মধ্যে স্বাধীনতার পরবর্তী ৭৫ এর পর রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রতি বাঙালী জাতির অনেক আস্থা, অনেক বিশ্বাস এবং অনেক অধিকার আছে।

অপরদিকে বাঙালী জাতির প্রতিও শেখ হাসিনার অনেক দাবী ও অনেক অধিকার আছে। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭১ এর ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঘোষনা দিয়েছিলেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা এসেছে। তবে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে এই ঘোষণার অপরাধে গ্রেফতার করে সে দেশের কারাগারে নিয়ে আবদ্ধ করে রাখে। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন বাংলাদেশ ও লাল সবুজের পতাকা।

দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠন করার প্রাক্কালে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ পরিবারের সকল সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যাকারীরা চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বাংলার মাটি থেকে মুছে ফেলতে। যে কারণে জেলখানার ভেতর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানের মতো জাতীয় নেতাকে। এরপর রাষ্ট্র নায়ক খন্দকার মুস্তাক, জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ বন্ধ করে দেয়। আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে করে পুনর্বাসিত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই বাঙালী জাতির হৃদয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং নাম নিশানা মুছে ফেলতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর তনয়া আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে দেশের সেবা ও আত্মনিয়োগ করার জন্য ছুটে আসেন বাংলাদেশে। এরপর পাকিস্তানি চক্র শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করে। পরম করুণাময় সৃষ্টি কর্তার অশেষ কৃপায় ও বাঙালী জাতির কোটি কোটি মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় বেঁচে যান তিনি।

১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হয়ে প্রথম সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। শুরু করেন উন্নয়ন কর্মকান্ডের মহাযজ্ঞ। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন। রাষ্ট্রের ইঙ্গিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহ আওয়ামীলীগ দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর চলে হামলা, মামলা, অত্যাচার, নির্যাতন। সারা দেশে হয়েছে সিরিজ বোমা, ২১ আগস্ট গ্রেনেট হামলা, এসব কিছু মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়ায় আওয়ামীলীগ। ওয়ান ইলিভেন সময়ে গ্রেফতার হন শেখ হাসিনা। এর পর মুক্তি পেয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন করেন।

২০১৪ সালে আবারো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি তারা ভেবেছিল বি.এন.পি নির্বাচনে অংশ না নিলে এ নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর এমনকি নির্বাচনই হবেনা। কিন্তু নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়েছে শেখ হাসিনাও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অনেক উচ্চতায়।

একথা সবারই জানা তিনি বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে করেছেন পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কাজ। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, ডিজিটাল বাংলাদেশ, খাদ্য নিরাপত্তার বাংলাদেশ শিক্ষা গ্রহণের বাংলাদেশ, উন্নয়নের বাংলাদেশ গড়ার কাজে এগিয়ে চলছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আওয়ামীলীগকে পরাজিত করার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, বি.এন.পি জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে জোট ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন। তাদের ধারনা ছিল এই বাংলাদেশের মানুষ বোধহয় আর নৌকায় ভোট দেবেনা। কিন্তু এই বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা এবং তাদের উত্তরসূরিদের ছাড়া আর যে কোথাও যেতে রাজী নয় এবার ভোটে তাই প্রমাণ করেছে।

নির্বাচনের দিন সকাল ৮ টা থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল সমকালের সাংবাদিক হিসেবে। সকাল ৮ টায় কেন্দুয়া সরকারি কলেজ কেন্দ্রে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী অসীম কুমার উকিল ভোট দেবেন তা জেনে ৭ টা ৫০ মিনিটেই আমি কেন্দ্রে গিয়ে অবস্থান নেই। অসীম উকিল ভোট কেন্দ্রে যান ৭ টা ৫৫ মিনিটে। ভোট কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে দুচারটি কথা হয় তিনি বিজয়ের আশ্বাস দিয়ে বলেন, আটপাড়া যাচ্ছি। এরপর আমার সহকর্মী সাব্বির আহমেদ খান অয়ন ও লুৎফর রহমান হৃদয়কে নিয়ে তেতুঁলিয়া, সাগুলী, চিথোলিয়া, গোপালাশ্রম, বড়তলা, মোজাফরপুর, গগডা, চিরাং, বাট্টা, কেন্দুয়া জয়হরি, মডেল, নওপাড়া, রামনগর, বেখৈরহাটি, ধনিয়াগাও, বাশাটি, গড়াডোবা, কাউরা, গন্ডা, সান্দিকোনা, রায়পুর, আদমপুর, সায়মা শাহজাহান একাডেমি কেন্দ্র ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। সকাল থেকে ২ টা পর্যন্ত প্রতিটি কেন্দ্রে নারী পুরুষ ভোটারের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়।

তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, নির্বাচনে কোন বিশৃঙ্খলা পরিবেশের সৃষ্টি হয়নি। সব প্রিজাইডিং অফিসার বলেছেন, নির্বাচন খুব সুন্দর সুষ্ঠু হয়েছে। আমি ও আমার সহকর্মীরাও সুন্দর নির্বাচন দেখেছি। তার পর সহকারী রিটানিং অফিসার রাত ৮টার দিকে ফলাফল ঘোষণা করেন। রাত ১০ টার মধ্যে সারা দেশ থেকেই নৌকার বিশাল বিজয়ের ফলাফল বেড়িয়ে আসে। এটি আওয়ামীলীগের প্রতি মানুষের আস্থার ফসল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা এনেছেন, শেখ হাসিনা গঠন করছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ।

এবার নির্বাচনের আগে ইশতেহার ঘোষনা করে তিনি (শেখ হাসিনা) বলেছেন দল ও পরিচালনা করতে গিয়ে মানুষ হিসেবে অনেক ভুলভ্রান্তি হতে পারে তার ক্ষমা করে দিয়ে দেশবাসীর প্রতি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নৌকা মার্কায় ভোট চান তিনি। তার মনোনীত প্রার্থীরাও যেমন অসীম উকিল সকাল ৮টা থেকে শুরু করে রাত ১০ টা পর্যন্ত প্রতিদিন ৮টি থেকে ১০টি পথসভা করেছেন। এভাবে দেড় শতাধিক পথসভা ও বিশাল দুটি জনসভা করে মানুষের কাছে দুহাত তুলে ভোট চাইছেন।

অপরদিকে কান্ডারীহীন তরীর মতোই ডুবে গেছে ধানের শীষ। কারণ বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান নেতাকর্মীদের সামনে না থাকায় এ করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশে মাত্র ৭ জন এম.পি নির্বাচিত হয়েছেন। এখন আবার ঘোষনা দিয়েছেন তারা শপথ নেবেন না, সংসদেও যাবেন না। তারা কি করবেন এটা তাদের ব্যাপার।

তবে আমি মনে করি এই ৭জনের কাছেই জনগণ তাদের ভোটের আমানত রেখেছিল সংসদে কথা বলার জন্য, তারা যদি সংসদে না যান তারা জনগণকেই অপমান করবেন। যা হোক আমি বলতে চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন বিশাল জয়ে বিশাল দায়িত্ব। এই বিশাল দায়িত্ব পালন করার যাত্রায় তিনি দূর্ণীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়েছেন। এখন তা বাস্তবায়নের পালা। এই সরকারের বিরোধী দল হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে বর্তমান যে অবস্থা তা আওয়ামীলীগের ভেতর থেকেই একমাত্র পালন করা সম্ভব।

আমি শেখ হাসিনার নিকট বিনিত অনুরোধ করি আপনি এই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গি মুক্ত, মাদক মুক্ত সুন্দর বাংলাদেশ গঠন করার অনেক সাফল্য অর্জন করেছেন। এখন আওয়ামীলীগের ভেতর থেকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করে আপনি এই বাংলাদেশে প্রমাণ করে দিন যে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষেই দেশের সুযোগ্য রাষ্ট্র নায়ক হওয়া সম্ভব যিনি, নিজ দলের ভেতর থেকেই বিরোধী দল তৈরি করে সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারে।

আর এই সমালোচনা করে যদি লাগাম টেনে না ধরা যায় তা হলে বিশাল জয়ের পথ মলিন হতে পারে। তাই বঙ্গবন্ধু কন্যার নিকট অনেক আশা এই বাঙালী জাতির, কারণ ২০৪১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল আওয়ামীলীগই যাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকে। আর সে দায়িত্বে আসার ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগকে অনেক সংযমী, ধৈর্য্য ও সহিষ্ণু হতে হবে।

লেখক : সমকাল সাংবাদিক ও সভাপতি কেন্দুয়া উপজেলা প্রেসক্লাব, নেত্রকোনা।