স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর : আজ ৬ই জানুয়ারি। দিনাজপুরের মহারাজা স্কুল মাইন বিষ্ফোরণ ট্রাজেডি দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে দিনাজপুরের মহারাজা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে এক আকষ্মিক মাইন বিস্ফোরণে একসাথে শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনা প্রায় ৫ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে অনেকেই। ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি একটি শোকাবহ দিন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে এতবড় ট্রাজেডির ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নেই। 

১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাস। দীর্ঘ ৯ মাস জীবনের বাজি রেখে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা লাল সবুজের একটি পতাকা ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র জাতিকে উপহার দিয়ে বাড়ীতে ফিরে গিয়ে পরিবার পরিজনের সাথে আনন্দ উৎসব করার কথা। কিন্তু তারা মনে করেছিলো দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসী এখনও শংকা মুক্ত নন। দেশ স্বাধীন হলেও পাক সেনাদের পুতে রেখে যাওয়া মাইনের কারনে এদেশে ভূমি এখনও দেশবাসীর জন্য স্বাধীন নয়। তাইতো তারা এদেশের ভূমিকে দেশবাসীর জন্য স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার উপযোগী করতে নিয়োজিত হয়েছিলো ভুমিতে পুতে রাখা মাইন অপসারনের কাজে।

দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীস্থ মহারাজা স্কুলে স্থাপন করা হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। এখানে অবস্থান নিয়ে প্রায় ৮ শত মুক্তিযোদ্ধা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে মাইন অপসারন করে জড়ো করছিলো এই ক্যাম্পে। ১৯৭২ সালের ৬ই জানুয়ারী ঠিক মাগরিবের নামাজের পর দুটি ট্রাক থেকে মাইন নামানোর সময় হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন ফসকে পড়ে যায় জড়ো করা মাইনের উপর। সাথে সাথেই বিস্ফোরন ঘটে জড়ো করা হাজারো মাইনের। কেঁপে উঠে গোটা দিনাজপুর। প্রান হারান সেখানে অবস্থান নেয়া প্রায় পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয় শত শত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের ছিন্ন ভিন্ন অংশ ছিটকে গিয়ে পড়ে আশেপাশে এবং গাছের ডালে। মুক্তিযোদ্ধাদের এসব ছিন্ন ভিন্ন অংশ জড়ো করে সমাহিত করা হয় সদর উপজেলার চেহেলগাজী মাজারে। সেখানে গণকবর দেয়া হয় তাদেরকে।

বিস্ফোরণে সেদিনের স্কুল ভবনটিও ধ্বংস হয়ে যায়, নিহত হন অনেকেই। সেদিনের বিস্ফোরনে কতজন নিহত হয়েছিল তার কোন সঠিক হিসেব নেই, তবে ৫ শতাধিক বলে জানান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা। এই দিবসটি পালন করে আসছে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।

দিনাজপুর সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ জানান,মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এতোবড় ঘটনা আর একটি নেই। নতুন প্রজন্মকে বিষয়টি জানানোর জন্য এই ঘটনাটি পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে ৬ই জানুয়ারী স্মৃতি পরিষদ। কিন্তু যুদ্ধের ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শহীদদের স্মৃতি বাস্তবায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের প্রতিশ্রুতি দিলে এখনও তা উপেক্ষিত।

অন্যদিকে ৬ জানুয়ারী স্মৃতি পরিষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক ছুটু জানিয়েছেন,স্বাধীনতার পরপরই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে একসাথে এত সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহতের ঘটনা দেশে আর কোথাও হয়নি। তাই এই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সরকারীভাবে উদ্যোগ নেয়ার দাবী সকলের। সেদিনের স্বাক্ষী যে মহারাজা স্কুল সেখানে সেদিনের যেসব স্মৃতি তা নতুন প্রজন্ম ও দেশবাসীকে জানানোর জন্য একটি জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনচেতা মানুষেরা।

(এসএএস/এসপি/জানুয়ারি ০৬, ২০১৯)