চৌধুরী আবদুল হান্নান


দুর্নীতির উর্বর ক্ষেত্র বিনষ্ট না করে বা উৎস মুখ বন্ধ না করে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার পূর্বে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থের মালিককে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা সহজ নয়, কারণ টাকার ক্ষমতা সীমাহীন। জনমনে বদ্ধমূল বিশ্বাস যে, যার অর্থের দাপট রয়েছে, সে বিচারের উর্ধে। দেশের মালিক জনগণ বিশ্বাস করে না যে, ঘুষ-দুর্নীতি রোধে কারও সদিচ্ছা আছে।

দুর্নীতি কতটা বিস্তার লাভ করেছে তা উপলব্ধি করতে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্যের দরকার নেই, চোখ কান খোলা রাখলেই এর ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। শিক্ষার হার বাড়ছে অন্যদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের প্রতিযোগিতাও বেড়ে চলেছে।

বঙ্গবন্ধু বলতেন- “আমার কৃষক, শ্রমিক দুর্নীতি করে না, দুর্নীতি কওে শিক্ষিত লোকেরা।” এদেশের অধিকাংশ মানুষ নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন, দুর্নীতির সাথে যুক্ত নয় কিন্তু অল্প সংখ্যক মানুষের লাগামহীন বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে দেশ আজ বিশ্বে দুর্নীতির সূচকে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। দেশের সকল জনগোষ্ঠী স্বল্প সংখ্যক মানুষের জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না।

আমাদের বিশ্বাস মন্ত্রণালয়ে সচিবরা যদি দুর্নীতি না করেন, তা হলে মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি হবে না, তেমনি প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি সৎ হন তাহলে দুর্নীতি নিশ্চিতভাবে কমে যাবে। পরিস্থিতিটা এমন দাড়িয়েছে যে, ঘুষের বিরুদ্ধে যতই কঠোর হওয়া যাবে, ঘুষ ততই বৃদ্ধি পাবে। কারণ তাতে ভাগিদারের সংখ্যা বাড়ে, পরিমানও বাড়ে। দাতা-গ্রহীতার দেখা হবে একান্তে “ছাঁদনাতলায়”।

সীমাহীন লোভের কারণে প্রতিযোগিতামূলকভাবে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে চলেছে। “দুর্নীতি দমনের উপায়” নিয়ে কত যে টিভি টক শো, পত্রিকায় বিজ্ঞ লোকদের তথ্যবহুল লেখা কম হয়নি। কয়েকদিন পূর্বে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের এক দীর্ঘ বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রশমিত হয়েছে (সমকাল ০৭-০১-১৯)। কিন্তু কোথাও দুর্নীতি প্রতিরোধের মূলমন্ত্র বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। তা কেবল কথার অলংকার সমৃদ্ধ।

ইতিপূর্বে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোথাও যে বড় বড় আর্থিক কেলেংকারী সংঘটিত হয়েছে, সেখানে কিছু সৎ, সাহসী কর্মকর্তা এ সকল দুর্নীতিতে বাধা সৃষ্টি করায় তাদেরকে যে হেনস্তা হতে হয়েছে তার কোনো প্রতিকার হয়নি, তারা হারিয়ে গেছে অতলে। আসলে এ জাতীয় লোকেরাই দুর্নীতি প্রতিরোধে মূল ভূমিকা পালন করতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠানই তাঁদের সুরক্ষা দিতে দেখা যায় না। যোগ্য, সৎ কর্মকর্তাগণ বর্তমানে কোনঠাসা হয়ে আছেন, তাঁদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের সুরক্ষা দেওয়া হলে অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের ভিতরেই একটি স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিরোধ শক্তি তৈরী হবে। যারা অন্যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের খোঁজ করতে হবে। এ সকল ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের নিকট থেকে এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতার তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। স্বপ্রনোদিত হয়ে অনেকেই এগিয়ে আসবেন এবং এতে একটি অজানা চিত্র পাওয়া যাবে যা ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।

দুর্নীতি দমনে যারা কোনোরকম অবদান রাখবেন, তাদের পুরষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। ভালো কাজের জন্য স্বীকৃতি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশংসাও চাকুরিজীবীদের জন্য বড় পুরষ্কার। সংবর্ধনার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা তাদের কর্মকর্তাদের অপরাধের শাস্তি বিধান করবে এবং কেবল প্রয়োজন হলেই দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠাবে।

আমাদের পচন যখন মাথায়, তাই এ দায়িত্ব সরকার প্রধানকেই বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। আর এবারের একাদশ সংসদ শেখ হাসিনাকে যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে তাতে দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের এক অবারিত দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশকে বিশ্ব দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে “সমাজের ক্যানসার” দুর্নীতি প্রতিরোধে বিশেষ দৃষ্টি দেবেন এ প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার