আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে থাকা প্রায় আট একর জমি অবৈধভাবে ইজারা প্রদানের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোন প্রকার টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই তিন বছরের জন্য ১৬ ব্যক্তির কাছে ওই জমি ইজারা প্রদান করা হয়েছে। 

বিনিময়ে তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী ও একজন সার্ভেয়ার মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এমন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ। পানি উন্নয়ন বোর্ড সদর দপ্তর পুরো অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে প্রায় দুই বছর পাউবো’র রাজস্ব শাখার সার্ভেয়ার হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন কার্যসহকারী শরিফুল ইসলাম শাহিন।

একই সময় পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন যান্ত্রিক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আজিজুল হক। তারা দুইজন দায়িত্বে থাকাবস্থায় ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ১৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন পরিমানে মোট ৭৯৯.৭৫ শতক জমি অবৈধভাবে ইজারা প্রদান করেন। কিন্তু এর রাজস্ব জমা হয়নি সরকারী কোষাগারে। ২০১৬ সালে জমির বিবরনী পাউবো সদর দপ্তরে প্রেরন করা হয়। তখন পূর্বের জমির সাথে সমানজস্যতা না থাকায় অনিয়ম ধরা পরে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অবৈধভাবে লিজ দেয়া জমির মধ্যে নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ড সাগরদী কার্যালয়ের পশ্চিম পাশে জেলা পরিষদ কর্তৃক অধিগ্রহনকৃত ১.৭৫ শতক জমির ইজারা গ্রহন করেছেন নির্মলেন্দু রায় বাবু নামের জনৈক ব্যবসায়ী। পূর্ব পাশে পাউবোর সীমানা প্রাচীর ঘেষে ০.০৫ শতক জমির ইজারা দেয়া হয়েছে ইউসুফ আলী মিলন নামের একজন সরকারী কর্মচারীকে। দুটি জমিতেই অবৈধভাবে বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মান করা হয়েছে। এরমধ্যে ১.৭৫ শতক জমির উপর দ্বিতল ভবন এবং অপর ০.০৫ শতক জমিতে একতলা টিন সেট ভবনে মার্কেট নির্মান করেছেন লিজ গ্রহিতাদ্বয়। দুটি জমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভবন ও স্থাপনা অপসারনের জন্য জেলা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট লিজ দাতাদের একাধিকবার নোটিশ দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আজিজুল হককে নির্দেশনা প্রদান করেন পাউবো’র পওর সার্কেলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রমজান আলী প্রামানিক। কিন্তু তার নির্দেশনার গুরুত্ব দেননি নির্বাহী প্রকৌশলী আজিজুল হক। এসব কারনে আজিজুল হককে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি সার্ভেয়ারের পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয় কার্যসহকারী শরিফুল ইসলাম শাহিনকে। তার আগে দুর্নীতির প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ৩০ জুন বরিশাল পাউবো’র অধীনে থাকা সকল জমির নতুন লিজ প্রদান ও পূর্বের লিজ গ্রহিতাদের নবায়ন কার্যক্রম বন্দের নির্দেশ দেয় পাউবো সদর দপ্তর।

এদিকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পাওয়া বাবুল আখতার পাউবো’র ইজারা চুক্তি ভঙ্গ করে ভবন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় ইজারা বাতিলের নোটিশ জারি করেন। কিন্তু পরবর্তীতে রহস্যজনক কারনে ১৬ জন ইজারাদাতাই তাদের দখল কার্যক্রমে বহাল থাকে। তাছাড়া ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাদের ইজারা মেয়াদ শেষ হলেও এখনও সবাই বহাল রয়েছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসলে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আজিজুল হক ও সার্ভেয়ার শরিফুল ইসলাম শাহিনকে শোকজ করা হয়েছিলো। পাশাপাশি ২০১৭ সালে তাদের কাছে ৭৯৯.৭৫ শতক ইজারাকৃত জমির রাজস্ব আদায়ের তথ্য দাখিলের নির্দেশ দেন বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ। কিন্তু তা দিতে ব্যর্থ হন সাবেক সার্ভেয়ার শরিফুল ইসলাম শাহিন।

অপরদিকে সরকারী জমি অবৈধভাবে লিজ প্রদানের বিষয়ে ঢাকা ও স্থানীয় পর্যায়ে তিন দফায় তদন্ত হয়েছে। এরমধ্যে ২০১৭ সালে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি দু’জনকে শোকজ করে। এদেরমধ্যে সার্ভেয়ার শরিফুল ইসলাম শাহিন ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল আত্মপক্ষ সমর্পন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শৃঙ্খলা পরিদপ্তরের পরিচালক বরাবর আবেদন করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারী টেন্ডার কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে ১৬ জন ব্যক্তিকে ৭৯৯.৭৫ শতক জমি ইজারা দেয়া হয়। ২০১৫ সালে ইজারা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি ভুলবশত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সেই সাথে ইজারার টাকা সরকারী কোষাগারে জমা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে ইজারা গ্রহনের বিষয়টি ধামাচাঁপা দিতেই ২০১২ সালকে টেনে আনা হয়েছে। তাছাড়া যে ১৬ জনকে ইজারা প্রদান করা হয়েছে পাউবো’র রেজিষ্ট্রার অনুযায়ী চারজন লিজ গ্রহিতা এখনও ইজারার জামানতের টাকা সরকারী কোষাগারে জমা দেয়নি। এরা হলেন বাকেরগঞ্জের বামনীকাঠির জসিম উদ্দিন, হিজলা উপজেলার মোল্লারহাটের হযরত আলী বেপারী, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার প্রদীপ কুমার ও একই উপজেলার অরুন চন্দ্র কর। অথচ ২০১২ সালের যে বিবরণি দাখিল করা হয়েছে তাতে ওই চারজনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ বলেন, এসব ঘটনা আমার দায়িত্বকালীন সময় ঘটেনি। তবে পুরও অভিযোগের বিষয়টি এখনও তদন্ত হচ্ছে। ২০১৮ সালের শেষদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সদর দপ্তরে এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিটি গঠণ হয়েছে। এরইমধ্যে তারা বরিশালে এসে সরেজমিনে তদন্ত করেছেন। পূর্নরায় তাদের বরিশালে তদন্তে আসার কথা রয়েছে।

(টিবি/এসপি/জানুয়ারি ২৪, ২০১৯)