কাজী নজরুল ইসলাম, শরীয়তপুর থেকে :

শতকরা দশ থেকে পনের টাকা ঘুষ না দিয়ে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ক্ষতিপূরনের অর্থ নিতে পারে না কেউ।

পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহনকৃত প্রায় ১ হাজার ১ শত একর জমির সর্বস্ব হারানো ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ৪ হাজার হতভাগার কাছ থেকে এভাবেই প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারি। পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্পের জাজিরা পয়েন্টের দূর্নীতি বিষয়ে সরেজমিন জানতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অসহায় মানুষের থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার এক ভয়ঙ্কর চিত্র।

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এল.এ.ও (ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তার কার্যালয়) শাখা। এ কার্যালয়টি এখন মানুষের কাছে একটি আতঙ্কিত নাম। এ কার্যালয়ের নামের সাথে পরিচিত নয় জাজিরার পদ্মা পাড়ে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই নগন্য। দেশের ২১ টি জেলার প্রায় ৫ কোটি মানুষের সুদীর্ঘ কালের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। অনেক চড়াই-উৎরাই, নাম-বদনামের পর সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এখন বাস্তবায়নের পথে হাটছে দেশের ইতিহাসের এই সর্ববৃহৎ বহুমুখি প্রকল্পটি। পদ্মা বহুমুখি সেতু নির্মানের জন্য ২০০৭ সাল থেকে সরকার শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলা থেকে বিপুল পরিমান জমি অধিগ্রহন করছেন। যা মানুষের বংশ পরম্পরায় বসত বাটি, ফসলী জমি, গাছপালা, পুকুর-দীঘি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এর অন্তর্ভূক্ত।

এই অধিগ্রহনের আওতায় পড়ে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ও পূর্বনাওডোবা ইউনিয়নের ১০০ নং এবং ১০১ নং মৌজার সরল খার কান্দি, মোহর আলী মাদবর কান্দি, হাজী হাছেন বয়াতীর কান্দি, সমর আলী মৃধা কান্দি, হাজী গফুর মোল্যার কান্দি, শহর আলী বেপারীর কান্দি, লতিফ ফকিরের কান্দি, সলিমুদ্দিন মাদবরের কান্দি, আহমেদ মাঝির কান্দি, হাজী জৈনদ্দিন মাদবরের কান্দি, কাদির মীনার কান্দি, জমির উদ্দিন হাওলাদারের কান্দি, আঃ মজিদ হাওলাদারের কান্দি, নঈমুদ্দিন খানের কান্দি সহ অন্তত ২৫টি গ্রামের ৪ হাজার ৮ শত ২৩ জন লোকের ১ হাজার ৯৩ একর জমি।

সেতু নির্মানের কন্সট্রাকশন স্টক ইয়ার্ড, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, পদ্মা রিসোর্ট এলাকা, টোল প্লাজা, রেল ষ্টেশন ও দুটি পূনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকার এই ব্যাপক এলাকার ভুমি অধিগ্রহন করে নেয়। ভূমি অধিগ্রহনের পর বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও সেতু বিভাগের মাধ্যমে সরকার জমির মালিকদের ক্ষতি পূরনের অর্থ প্রদান করতে থাকে। ২ শত ৯১ কোটি ৬০ লক্ষ ৫১ হাজার টাকা শুধু জেলা প্রশাসনেরই প্রদান করার কথা। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ২০ মে পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের জমি, ঘর-বাড়ি, ফসল, বৃক্ষ, পুকুর-নালা ইত্যাদির মূল্য হিসেবে সরকার ২ শত ৫৮ কোটি ৬১ লক্ষ ১৭ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। এর বাইরেও সেতু বিভাগ ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ বা সিসিডিবি নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুধুমাত্র জমির বদলি মূল্য বাবদ পরিশোধ করেছে ৯৭ কোটি টাকা।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, পরিশোধকৃত টাকা থেকে ক্ষেত্র বিশেষ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ২৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ঘুষ দেওয়া থেকে রক্ষা পাননি কোন শ্রেনী-পেশার মানুষই। সময়মত ঘুষ প্রদান করতে না পেরে এখনো ক্ষতিপূরনের টাকা হাতে পাননি এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ। তাদেরও নিয়মিত গুনতে হচ্ছে ঘুষের টাকা। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ক্ষতিপূরনের টাকার চেক নিতে আসা ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে তথ্য জানতে চাইলে তারা ভয়ে কোন কথা বলতে চাননা। মুখ ফিরিয়ে নেন ক্যামেরা থেকে।

পদ্মা সেতুর দূর্নীতির অনেক রোমহর্ষক ইতিহাসও সৃষ্টি হয়েছে ইতিমধ্যে। বহু রাঘব বোয়ালদের পদস্খলনও হয়েছে। দূদকের কাঠগড়ায় মাথা নত করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকেও। কিন্তু ধর্ম-বর্ন, দরিদ্র-ধনি নির্বিশেষে সকল স্তরের সবহারানো মানুষের কাছ থেকে এত বিশাল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন এখনো রয়ে গেছে সম্পূর্ন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ঘুষ প্রদানের কষ্ট জড়ানো তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানতে গিয়ে এ প্রতিবেদক কথা বলেছেন জাজিরার নাওডোবা বয়াতি কান্দি গ্রামের শত বর্ষী বৃদ্ধা আয়াতুন নেছার সাথে। তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেছেন, পদ্মা সেতু বানানের নেইগ্যা (নির্মানের জন্য) আমার চার বিঘা জমি সরকার নইয়া (নিয়া গেছে)। আমারে মোডে (মাত্র) চার লাখ টাহা দিছে। হেই টাহার তোন আবার এক লাখ টাহা ডিসি অফিস ঘুষ রাইখ্যা দিছে।

মৃধা কান্দি গ্রামের তাসলিমা বেগম (৫০) জানালেন, সরকার তাদের জমি সহ ঘর বাড়ি সব কিছুই অধিগ্রহন করেছে। মোটা দাগের ঘুষের মাধ্যমে জমির ক্ষতিপূরনের টাকা উঠাতে পারলেও ঘুষ না দিতে পারায় ঘর-দরজা ও গাছ-পালার টাকা ঠিকমত পাওয়া যায়নি।

মিডিয়ার সাথে কথা বলায় জেলা প্রশাসনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা সত্বেও লতিফ ফকিরের কান্দি গ্রামের আলাউদ্দিন মৃধা, আহমেদ মাঝি কান্দি গ্রামের আব্দুল জলিল মাঝি, আব্দুল গফুর মোল্যা কান্দি গ্রামের জসিম উদ্দিন, শহর আলী বেপারীর কান্দি গ্রামের বাচ্চু মিয়া, বয়াতি কান্দি গ্রামের দাদন বয়াতি, সলিমুদ্দিন মাদবর কান্দি গ্রামের লাভলু মৃধা, হাজী জৈনদ্দিন মাদবর কান্দি গ্রামের নোয়াব আলী শেখ ও আব্দুল মজিদ হাওলাদারের কান্দি গ্রামের মো. মিলন বেপারী গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে অত্যন্ত আবেগ জড়িত কন্ঠে বলেন, আমাদের বাপ-দাদা সাত পুরুষের ভিটা মাটি পদ্মা সেতুর জন্য ছেড়ে দিয়েছি। তিন চার বছর ঘুরে শতকরা ১০ থেকে ১৫ টাকা ডিসি অফিসে ঘুষ দিয়ে আমাদের ক্ষতিপূরনের টাকা উঠাতে হচ্ছে। তারা বলেন, পদ্মা সেতু দূর্নীতির জন্য মন্ত্রীরও বিচার হয়েছে। কই, শরীয়তপুরের ডিসি-এডিসি‘র তো কোন বিচার হলো না ?

সীমাহীন এই ঘুষ-দূর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রাম চন্দ্র দাস। তিনি শুধু বলেন, ক্ষতিপূরনের টাকা পরিশোধের বিষয়টি তার দায়িত্বের বাইরে।


(কেএনআই/অ/জুলাই ২১, ২০১৪)