বিজ্ঞান ডেস্ক : বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ শব্দটি স্থূল অর্থে আদি একটি বিন্দুর অতি শক্তিশালী বিস্ফোরণকে বোঝায় যার মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। এর মাধ্যমেই মহাবিশ্বের প্রাচীনতম বস্তুগুলোর গঠন সম্পর্কে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

আদিমতম মহাবিশ্বের সেই সৃষ্টি-প্রক্রিয়া প্রথমবারের মতো দেখল নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে, বিগ ব্যাংয়ের পর সুদূরতম অতীতের কোনো মহাজাগতিক বস্তুকে এতটা উজ্জ্বলভাবে এর আগে দেখা যায়নি।

সংস্থাটি বলছে, ১২৮০ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হওয়া সেই অসম্ভব জোরালো আলো এটি। ৬০০ লক্ষ কোটি সূর্য এক সঙ্গে জ্বললে, যে পরিমাণ আলো হয়, ততটাই উজ্জ্বল ছিল সেই আলো।

নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ তো দূরের কথা, কোনো গ্যালাক্সিরও জন্ম হয়নি তখন। সেই গ্যালাক্সির যেটা ভ্রূণ, সেই কোয়েজারও তখন সবে আকার নিতে শুরু করেছে। যাকে ‘প্রোটো-কোয়েজার’ও বলা যায়। এরও ১০০ কোটি বছর আগে হয়েছে সেই বিগ ব্যাং। কোয়েজারটির নাম দেয়া হয়েছে, ‘J043947.08+163415.7’।

বিস্ফোরণের পরে দৈত্যাকার ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরদের জন্ম হয়। গ্যালাক্সি তৈরি হওয়ার জন্য যে অত্যন্ত ঘন গ্যাসের জমাট বাঁধা মেঘের সঙ্গে ধাতব পদার্থের ধুলোবালিও লাগে, তখনও তৈরি হয়নি সেই ধুলোবালি। ছিল শুধুই হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের জমাট বাঁধা গ্যাসের অত্যন্ত ঘন মেঘ।

জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে তখন সব কিছুই নিজের দিকে টানতে শুরু করেছে ব্ল্যাকহোলগুলো। আর তার পেটে ঢুকছে যে গ্যাসের জমাট বাঁধা মেঘ, তারা অতলের আহ্বানে তলিয়ে যাওয়ার সময় চার পাশে ছড়াচ্ছে বিকিরণ। সেই বিকিরণই ব্ল্যাকহোলের চারপাশে এক ধরনের আলোর বলয় তৈরি করছে।

বিগ ব্যাংয়ের সামান্য সময় পরেই সদ্য জন্মানো কোয়েজার এই আলো ছড়িয়েছে। তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যে কোয়েজার পৃথিবী থেকে ১২৮০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, কীভাবে তাকে এতটা উজ্জ্বলভাবে দেখতে পেল হাবল স্পেস টেলিস্কোপ?

বিষয়টি খোলাসা করেছে নাসা। পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা বড় একটা গ্যালাক্সি হঠাৎই সামনে এসে পড়েছিল হাবল টেলিস্কোপের। আর তাতেই কেল্লা ফতে! ওই বড় গ্যালাক্সিটাই তখন হাবলের সামনে হয়ে পড়ে একটি আতশ কাচ বা ম্যাগনিফাইং গ্লাস।

সামনে আতশ কাচ ধরলে যেমন সব কিছুকেই অনেক গুণ বড় করে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। আমরা যদি কোনো বস্তুকে বড় আকারে দেখতে চাই, তাহলে আতশ কাচকে তার থেকে যত দূরে নিয়ে গিয়ে আমাদের চোখের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়, ততই তাকে আমরা আরও বড় আকারে দেখতে পাই। আর সেই বস্তুটি থেকে যদি আলো ঠিকরে বের হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তার উজ্জ্বলতাও বেড়ে যায় অনেক গুণ।

মহাবিশ্বের উজ্জ্বলতম কোয়েজারটি দেখার সময়েও সেই ঘটনাটা ঘটেছে। এর মানে, ওই কোয়েজারটিকে উজ্জ্বলভাবে দেখার জন্য যে গ্যালাক্সিটা আতশ কাচের মতো কাজ করেছে, সেই গ্যালাক্সিটা ছিল পৃথিবীর কাছাকাছি। তা নাহলে ওই কোয়জারটিকে অতটা উজ্জ্বলভাবে দেখা সম্ভব হতো না।

মহাকাশে কোনো মহাজাগতিক বস্তুকে আতশ কাচের মতো ব্যবহার করে অনেক দূরের ঘটনাকে দেখার কৌশলকে বলা হয় ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’। যেকোনো মহাজাগতিক বস্তুরই ভর থাকে। থাকে অভিকর্ষ বলও। ভরের তারতম্যে তার সেই বলেরও ফারাক ঘটে। যার ভর যত বেশি, তার অভিকর্ষ বল ততটাই জোরালো হয়। আর সেই অভিকর্ষ বলের জন্যই মহাবিশ্বের স্থান ও কাল (স্পেস অ্যান্ড টাইম) এর ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটে।

ফলে, খুব দূরের জিনিস থেকে বেরিয়ে আসা আলোর গতিপথকেও পরিবর্তন করে তাকে কাছে টেনে আনে। তার ফলে সেই দূরের বস্তুটিও উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। আবার ‘আতশ কাচ’ হয়ে ওঠা সামনের সেই গ্যালাক্সিটা যখন সরে যায়, তখন দূরাগত সেই আলোর উজ্জ্বলতাও কমে যায়।

একদিন, দু’দিন বা দু’-এক বছর নয়। টানা ২০ বছর ধরে ওই কোয়েজারটির ওপর নিয়মিত নজর রেখে এসেছেন গবেষকরা। মূল গবেষক টাকসনের আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিয়াওহুই ফ্যান তাদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘মহাবিশ্বের যতটা অংশ এখনও পর্যন্ত দৃশ্যমান, তার মধ্যে এর চেয়ে উজ্জ্বল কোনো কোয়েজার আর দেখা যাবে বলে আশাও করি না।’ তারা জানিয়েছেন, যে গ্যালাক্সির ভ্রূণ ওই কোয়েজারটি, সেই গ্যালাক্সিতে খুব দ্রুত হারে চলছিল তখন নক্ষত্র-সৃষ্টির প্রক্রিয়া।

বছরে ১০ হাজারেরও বেশি তারা জন্মাচ্ছিল ওই শিশু গ্যালাক্সিতে!

বিষয়টা অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য যে, একটা পার্থিব বছরে ১০ হাজারেরও বেশি নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছিল তখন ওই গ্যালাক্সিতে। তবে সেটা কতটা দ্রুত, তা বুঝতে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। আমাদের মিল্কি ওয়েতে এক বছরে গড়ে একটি করে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়।

(ওএস/অ/ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৯)