শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট  : বাগেরহাটের মোংলা উপজেলায় নানা আয়োজনে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃতিম বিদেশী বন্ধু ফাদার মারিনো রিগনের ৯৫তম জন্মদিন পালিত হয়েছে। 

জন্মদিন উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল ৮টায় মোংলা উপজেলার শেহলাবুনিয়ার ক্যাথলিক গির্জা প্রাঙ্গণে রিগনের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তার নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠন। পরে সাড়ে ৮টায় সেখান থেকে বের হওয়া শোভাযাত্রাটি রিগনের স্মৃতি বিজড়িত শেহলাবুনিয়া-বটতলা প্রদক্ষিণ করে মোংলা সরকারী কলেজে গিয়ে শেষ। মোংলা সরকারী কলেজ, সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সরকারী কলেজ চত্বরে আয়োজিত স্মরণানুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার খালেক।

ফাদার মারিনো রিগনের জন্মদিন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় খুলনা সিটি মেয়র বলেন, আমাদের দেশপ্রেমের অনেক অভাব রয়েছে। ফাদার রিগনের দেশপ্রেম আর আমাদের দেশপ্রেমের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। কারণ তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেবার মধ্যেই ছিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্য্য বিষয় হলো, ফাদার রিগন যখন খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়েন তখন তার পরিবারের লোকজন তাকে এখান থেকে ইতালিতে নিয়ে যেতে আসেন। তখন রিগন তাদেরকে শর্ত দিয়েছিলেন আমি মারা গেলে আমার লাশ শেহলাবুনিয়াতে পাঠাতে হবে এবং শেহলাবুনিয়াতে সমাহিত করতে হবে।

এদেশের মানুষের প্রতি তার ভালবাসার নিদর্শন এটি। শেষ পর্যন্ত মারা যাওয়ার এক বছর পর হলেও তার মরাদেহ সুদূর ইতালি থেকে এনে শেহলাবুনিয়াতে সমাহিত করা হয়েছে, এটা ফাদার রিগনের এদেশের ও মানুষের প্রতি সেবার প্রেম। সুতরাং ফাদার রিগনের জীবনী অনুসরণ ও অনুকরণ করে আমাদের কর্মময় জীবন গড়তে পারলেই মানুষের মত মানুষ হওয়া সম্ভব হবে।

মোংলা সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম সরোয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণানুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে মোংলা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তাহের হাওলাদার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইকবাল বাহার চৌধুরী, সম্মিলিত সাংস্কৃততি জোটের আহবায়ক নুর আলম শেখ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুনীল কুমার বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক ইব্রাাহিম হোসেন, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুস সালাম, সাধারণ সম্পাদক শেখ আ. রহমান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ই¯্রাফিল হাওলাদারসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানের শেষভাগে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী ফাদার মারিনো রিগন ইতালির ভেনেতো প্রদেশের ভিসেঞ্জা জেলার ভিল্লাভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালের জানুয়ারীতে ধর্ম প্রচারের কাজে রিগন বাংলাদেশে আসেন। এরপর টানা ৬৩ বছর ধরে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার শেহলাবুনিয়া গ্রামে থেকে তিনি এ এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তারে নিজ উদ্যোগে ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নারীদের জন্য গড়ে তোলেন শেলাই কেন্দ্র ও শিক্ষার্থীদের থাকার হোস্টেল। এদেশে থাকাকালীন ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও সামাজিক কর্মকান্ডে অসামান্য অবদান স্বরূপ ২০০৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে।

এছাড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গীতাঞ্জলীসহ ৪৮টি বই, কবি জসিম উদ্দিনের নকশী কাথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট, লালনের সাড়ে তিনশ গান ইতালি ভাষায় অনুবাদ ও সংকলন করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। স্বীকৃতি স্বরূপ পান অনেক সম্মাননা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভিনদেশী অকৃত্রিম বন্ধু, অনুবাদক, সাহিত্যিক, কবি, আর্কিটেক্ট ও শিক্ষানুরাগী ফাদার মারিনো রিগন মোংলার শেহলাবুনিয়াতে শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ্য হয়ে পড়ার পর তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে নিয়ে যান। তবে পরিবারের কাছে তার শর্ত ছিল তিনি মারা গেলে যেন তাকে শেহলাবুনিয়াতেই সমাহিত করা হয়। ইতালিতে চিকিৎসাধীন অবস্থান থাকাকালীন ২০১৭ সালে ২০ অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর এক বছর পর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার মরাদেহ ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর ইতালি থেকে বাংলাদেশে এনে বাগেরহাটের মোংলার শেহলাবুনিয়ায় চার্চে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

(এসএকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৯)