দীপক চক্রবর্তী, মাগুরা : বন্যা, অপরিকল্পিত বাঁধ, দখলদারদের দখল, ময়লা-আর্বজনা, কচুরিপানা জমাট এর ফলে নদীর তলদেশ শুকিয়ে নাব্যতা হারিয়ে বিলুপ্তী হতে  চলেছে মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ফটকি ও চিত্রা নদী। 

সংস্কারের অভাবে এ নদী দুটি প্রায় মৃত হতে চলেছে।ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের সুস্বাদু দেশীয় প্রজাতীর সকল প্রকার মাছ ও জীব বৈচিত্র। বিঘ্ন ঘটছে কৃষি জমিতে সেচ দানে। নদী দুটি সংস্কার হলে কৃষি জমিতে সেচ সুবিধাসহ রক্ষা পাবে ওই এলাকার জীববৈচিত্র। যা আর্থ-সমাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

এককালের প্রবাহমান খর স্রোতা নদী শালিখার ফটকি ও চিত্রা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে শুকিয়ে নব্যতা হারিয়ে প্রায় মৃত অবস্থা। ফটকি নদীটি ভারতের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিম বাংলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অতপর ঝিনাইদহের মধ্য দিয়ে মাগুরা সদর ও শালিখা উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে ধনেশ্বরগাতী, ভাটোয়াইল, আড়পাড়া, শলই হয়ে বুনাগাতীর সোনাকুড়ে চিত্রা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৯ কিঃমিঃ। অপর দিকে, চিত্রা নদীটি চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ শালিখা উপজেলার দক্ষিন সীমানা ঘেঁষে নড়াইলজেলার মধ্যগোপাল গঞ্জের দিকে ধাবিত হয়েছে। ত্রিশ বছর আগেও এ নদী দুটি ছিলো অত্র এলাকার গর্ব ।

এ নদীর উপর ভর করে প্রসার ঘটেছিলো এলাকার ব্যবসা বানিজ্যের। এ নদীর জন্যই এক কালের মাগুরা সদর উপজেলার মঘী ইউনিয়নের ভাবনহাটি বাজার, শালিখা উপজেলার সীমাখালী, হাজরাহাটি,বুনাগাতী, গড়েরহাট, পুলুম ও গঙ্গারামপুর বাজার ছিলো অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র। খুলনা,বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড়-বড় পাল তোলা নৌকা আসতো এ এলাকায় ধান, পাট, আম, কাঁঠাল,বেল,খেজুর গুড় সহ বিভিন্ন কৃষি পন্য ক্রয় করতে। একই সাথে নদী দুটির সাথে সংযুক্ত খাল গুলি দিয়ে ডিঙ্গি নৌকা করে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা তাদের কৃষি পন্যসহ বিভিন্ন পন্য সামগ্রী বাজারে বিক্রয়ের জন্য আনতো।

এছাড়া এ নদী দুটি শুকানোর সাথে-সাথে সংযুক্ত প্রায় ২০টি খাল ও ৩০টি বিল এখন কৃষি জমিতে পরিনত হতে চলেছে। নদীসহ এসকল খাল-বিলে পাওয়া যেতো বিভিন্ন প্রকার দেশীয় প্রজাতির মাছ। দেশীয় প্রজাতীর মাছের মধ্যে পুঁটি,ট্যাংরা,কৈ,শিং, পাবদা, বাইন, খয়রা, ফলই, রয়না, চাঁদা,শৈল, গজার, কালবাউশ, চিতল, রুই, মৃগেল,কাতল,বোয়াল প্রভৃতি দেশীয় প্রজাতীর মাছ পূর্বে পাওয়া যেতো, যা এখন বিলুপ্তীর পথে। পূর্বে এ নদী দুটিতে ডলফিন দেখা গেছে, যা এখন আর দেখা যায়না। শুধু তাই নয় নদী ও খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার সাথে-সাথে সকল জীব বৈচিত্রও হারাতে বসেছে।

এলাকাবাসী জানান, এ নদী খনন হলে বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় জনসাধারণের গোসলের জন্য ও মাছ চাষ বৃদ্ধির সহায়ক হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের নিরাপদ জীবনযাত্রা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নদী তীরবর্তী এলাকাবাসী কৃষি জমিতে সেচ সুবিধাসহ শুষ্ক মৌসুমে নানা কাজে নদীর পানি ব্যবহার করতে পারবে।

জেলা পানি উন্নয়নবোর্ডের দেয়া তথ্য মতে, চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে নব গঙ্গার উৎপত্তি। মাগুরা শ্রীপুর উপজেলার কুমার নদ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাগুরা পৌরসভার পারনান্দুয়ালী এলাকায় এসে নবগঙ্গা নাম ধারণ করেছে। ভারতের উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, নদীর বিভিন্ন অংশে অপরিকল্পিত বাঁধ ও ব্রিজ নির্মাণ, পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে নদীটি। যে কারনে নদীর বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে চর। নদীর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে’ নদীটির ১১ কিলোমিটার এলাকা খননে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়। যা সম্প্রতি অনুমোদন হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় নদীর তলদেশে পলি জমে উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাগুরা জেলার সদর উপজেলাধীন বড়বিলা বিল, কৈবিলা বিল, পুটুলিয়া বিল, রূপদাহ বিল এলাকার জমির জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে নবগঙ্গা নদী পুনঃখনন করা অত্যন্ত জরুরী ছিল। বর্তমানে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পর এ বছরেই নদী সংস্কারের কাজ দ্রুতই শুরু হতে যাচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত হলে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, বন্যার পানি নিষ্কাশন, ফসল রক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বন্যাকালীন সময়ে এলাকাবাসীর নিজ ঘরে অবস্থান এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সফল হওয়ার পাশপাশি প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে ১২ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন সম্ভব হবে। এতে এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে।

মাগুরা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বলেন, নবগঙ্গা নদী সংস্কারের প্রস্তাবটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর পরিকল্পনা মন্ত্রনালয় একনেকের বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। অনুমোদনের ফলে ১১ কিলোমিটার নদী খননসহ অন্যান্য সংস্কার কাজ বাস্তবায়িত হতে চলেছে।যা একদিকে যেমন জীববৈচিত্র, প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং পরিবেশ রক্ষা পাবে। পাশাপাশি কৃষি জমিতে সেচ কার্যক্রম চালানোসহ নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে অবদান রাখবে।

অন্যদিকে গড়াই, ফটকী, চিত্রা,বেগবতী ও কুমার নদীর সংস্কারের অভাবে বর্ষা মৌসূমে প্লাবিত হয়ে দুই পাড় ভেসে হাজার-হাজার একর ফসলী জমি ও ঘর-বাড়ি তলিয়ে যায়। ফলে প্রতি বছরই নদী পাড়ের মানুষদের পোহাতে হয় চরম র্দূভোগ। আবার শুস্কো মৌসূমে নদী গুলি শুকিয়ে যায়। ফলে নৌযান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকার নবগঙ্গা খননের জন্য ৪১ কোটি টাকার একনেকে প্রকল্প বরাদ্ধের কাজ শুরু হলেও অন্য নদী গুলো খননের কোন ব্যবস্থা এখনও নেওয়া হয়নি।

(ডিসি/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৯)