রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা থেকে : শহীদ স ম আলাউদ্দিন ১৯৪৫ সালের ২১ আগস্ট সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মিঠাবাড়ী গ্রামের এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ আলী সরদার ও মাতা সখিনা খাতুন। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। কলারোয়া জি কে এম কে পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬৪ সালে সাতক্ষীরা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬৭ সালে খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজ থেকে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৭ম স্থান অধিকার করে স্নাতক (বিএ) পাশ করেন।

১৯৬৮ সালে তালা উপজেলার জালালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে তালা-কলারোয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে সর্ব কনিষ্ঠ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়ায় ট্রেণিং শেষে সরাসরি অস্ত্র হাতে যে ক’জন সংসদ সদস্য অংশ নেন, শহীদ স ম আলাউদ্দিন তাদের অন্যতম। ১৯৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ভোগ বিলাসের জীবন-যাপন না করে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদে যোগদান করেন। ১৯৮০ সালে জাসদ দু’ভাগে বিভক্ত হলে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোর দুর্দিনে পুনরায় আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৮৩ সালে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকী ছিলেন সভাপতি। মুনসুর আহমেদ সাধারণ সম্পাদক এবং স ম আলাউদ্দিন সাংগঠনিক সম্পাদক। এই ত্রিরত্ন জেলার ৭৮টি ইউনিয়নের সাতটি থানায় ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন। বিশেষ করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে তার সাংগঠনিক তৎপরতা জেলা আওয়ামী লীগে গতি সঞ্চয় করে। বিশেষ করে ১৯৮৬ সালের ৭ মে’র জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তালা-কলারোয়া থেকে সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকীর প্রধান নিবার্চনী এজেন্ট নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তিনি তার কর্ম দক্ষতায় সাকী সাহেবকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী করেন এবং দেবহাটা-কালীগঞ্জ থেকে দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক মুনসুর আহমেদ সাবেক বস্ত্রমন্ত্রী অ্যাড. মুনসুর আলীকে পরাজিত করে সর্ব প্রথম জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জেলা আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে স ম আলাউদ্দিনের ভক্ত অনুরাগীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় উপজেলা নির্বাচনে তিনি তালা উপজেলার চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আব্দুল আলীর নিকট তিনি পরাজিত হন। আব্দুল আলীর এই নির্বাচনে তৎকালিন তথ্যমন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখ্তের কালো হাত ছিল বলে প্রচার রয়েছে। আর সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকী সব কিছু জানা সত্ত্বেও কার্যকরি কোন জোরালো ভূমিকা পালন করেন নি, এমন অভিযোগ স ম আলাউদ্দিনকে বলতে একাধিকবার শোনা গেছে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেবহাটা-কালীগঞ্জ থেকে মুনসুর আহমেদ দলীয় একমাত্র প্রার্থী হিসাবে সাংসদ নির্বাচিত হন। অন্য চারটি আসনে জামায়াত জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকীর পরাজয়ের জন্য অন্যান্যদের সাথে স ম আলাউদ্দিনের প্রতি ইঙ্গিত করে দোষারোপ করা হতো। এর কিছুপর জেলার রাজনীতিতে কিছু নয়া মেরুকরণ লক্ষ্য করা যায়। ১৯৯২ সালে স ম আলাউদ্দিন জেলার রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে তালা উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক হন তৎকালিন তুখোড় ছাত্রনেতা শেখ নূরুল ইসলাম। শেখ নুরুল ইসলাম ছিলেন সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকীর আর্শীবাদ পুষ্ট। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ধূমকেতুর মত আবির্ভাব হলেন ঢাকা প্রবাসী অর্থ ও বিত্তশালী প্রকৌশলী মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজিবুর রহমান। সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকীর আর্শীবাদ পুষ্ট হয়ে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুনসুর আহমেদ জেলার একমাত্র সংসদ সদস্য। তৎকালিন ঢাকার মেয়র হানিফকে সাতক্ষীরায় আনা ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করাসহ সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকী’র একক নেতৃত্বে ভাগ বসান তারই শিষ্য মুনসুর আহমেদ। এই সমস্ত ঘটনা সাকী সাহেব কে ক্ষুদ্ধ করে। তার প্রতিশোধ হিসাবে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জেলার সাংসদ হিসেবে সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকী, ডা. মোখলেছুর রহমান ও এ কে ফজলুল হক নির্বাচিত হলেও মুনসুর আহমেদ মাত্র দেড় হাজার ভোটে পরাজিত হন। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। সকল উন্নয়ন কর্মকা- সাংসদ ও দলের সভাপতি সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকী কেন্দ্রিক। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে স ম আলাউদ্দিন হজ্বব্রত পালন শেষে তালা-কলারোয়া থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন বোর্ডে আবেদন করেছিলেন, তখন বর্ষীয়ান মানুষ হিসাবে সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকীকে দলীয় মনোয়ন দিলে স ম আলাউদ্দিনকে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে পুরস্কৃত করা হবে বলে জননেত্রী শেখ হাসিনা আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে সাকী সাহেব স ম আলাউদ্দিন কে বিশ্বাস করতে না পারায় তাকে কোন দায়িত্ব দেন নি। স.ম আলাউদ্দিন সাতক্ষীরার সদর আসনে দলের নবীন প্রার্থী নজরুল ইসলামের পক্ষে সদরের ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ব্যাপক গণসংযোগ এবং প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন।

১৯ জুন, ১৯৯৬। সেদিন কয়েকটি গোলোযোগ পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় ভোট গ্রহণ শেষে বেতার ও টেলিভিশনে ভোটের ফলাফল নিজ পত্রিকা দৈনিক পত্রদূত অফিসে বসে পত্রিকার কাজ ও ভোটের ফলাফল টেলিভিশনে শুনছিলেন। সেদিন ছিল আষাড়ের বৃষ্টিমূখর রাত, ঘাতক ও তাদের গডফাদাররা একাধিকবার রেকি করেছে তার অবস্থান। তখন রাত ১০টা ২৩ মিনিট, হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। অনেকেই ভাবলো নির্বাচনে জয়ের আনন্দ উল্লাস করছে পটকা ফুটিয়ে। কিন্তু না নিজ চেয়ারে কর্মরত অবস্থায় মাথার ঠিক নিচে একটি ছোট ছিদ্র ভেদ করে মুখের বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে এক ইঞ্চি গর্ত। নেতা টেবিলের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন, গলার নিচ দিয়ে অবিরাম লাল রক্ত চেয়ার গড়িয়ে পড়তে লাগলো কংক্রিটের মেঝেতে। অতঃপর তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়া হল। তার মধ্যে সব শেষ। দূরে দাঁড়িয়ে ঘাতক ও তাদের গডফাদাররা সব কিছু দেখছিল, এমন কি মৃত্যু নিশ্চিত কি না তা জানার জন্য হাসপাতালেও গিয়েছিল, প্রিয়তম স্ত্রী ডাইনিং টেবিলে ভাত খুলে রেখেছিলেন, স্নেহের কন্যা পাপিয়া, রোজিনা, সুমি, মুক্তি, সেজুতিরাও অপেক্ষা করছিল। বাবার সাথে ভাত খাবে একত্রে। শিশু জয় হয়তো তখন দোলনায় গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। কিন্তু না ততক্ষণে সবশেষ। খবর শুনে ছুঁটে জান বর্তমান পত্রদূতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ, সাবেক সাংসদ এএফএম এন্তাজ আলী, সাংবাদিক আবু আহম্মেদ, আনিসুর রহিম, কল্যাণ বানার্জি, স্ত্রী লুৎফুন্নেছা বেগম, সন্তান, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও তার শুভান্যুধায়ীরা।সকালে লাশের ময়না তদন্ত হল। মানুষ স্রোতের মত ডোম ঘরের দিকে পাগলের মত ছুটতে লাগলো, সবার মনে ক্ষোভ। দুঃখ এবং চোখে প্রতিবাদের আগুন। স্মরণকালের সব থেকে বড় শোক মিছিল হল। জানাযা শেষে তারই পৈত্রিক ভিটা মিঠেবাড়িতে সমাহিত করা হল তাকে।

প্রতি বছর ১৯ জুন তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। কিন্তু তার দল জেলা আওয়ামী লীগ তার জন্য পৃথক কিছুই করে না, এমন কি তার কবরস্থানেও জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পুষ্পমাল্য দিতে দেখা যায় না। সারা বছর নিশ্চুপ থাকার পর বছরে এই একটি দিন স ম আলাউদ্দিন স্মৃতি সংসদ তার জন্য পাটকেলঘাটা পাঁচ রাস্তার মোড়স্থ শহীদ আলাউদ্দিন চত্বরে শোক সভা করে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সেখানে বক্তব্য রাখেন, ঐ পর্যন্ত সব শেষ। আর কোন খবর নেই। তার পত্রদূত পত্রিকাও দিনটি পালন করে দায়সারাভাবে। উপজেলা পর্যায়ে তেমন কোন কর্মসূচি থাকে না। বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম করে পত্রদূত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন তার জামাতা অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ। মাথার উপর থেকে ছাদ খসে পড়ার পর লুৎফুন্নেছা বেগম চার মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘ সাগড় পাড়ি দিচ্ছেন। সে পথ বড় কষ্টের। পাপিয়া, সেজুতি ও মুক্তির বিয়ে দিয়েছেন। রোজিনা লন্ডনে থাকে। সুমি বাড়িতে ও একমাত্র ছেলে জয় ঢাকায় পড়াশুনা করে। আলাউদ্দিন পরিবার গত ১৭টি বছর কি অবস্থায় আছে, তারও কোন খবর রাখে না কেউ। স ম আলাউদ্দিন ভক্ত বড় কাশিপুরের শেখ সিরাজুল ইসলাম দুর্ঘটনায় নিহত ও ইকতিয়ার গত জেলা কাউন্সিলে মুনসুর আহমেদের সাথে সঙ্গ দেয়ার কারণে তাকে স্মৃতি সংসদ থেকে দীর্ঘদিন বাদ দেওয়া হয়েছিল। নগরঘাটার আব্দুল আহাদ সরদার আজ আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। ইকতিয়ার আর বিশ্বাস আতিয়ারের নেতৃত্বে ১৯ জুন ২০১৩ পালন করা হয়। তাদেরকে কে কতটুকু সাহায্য সহযোগিতা করছে সেটা ভাবতেই হতাশা সৃষ্টি হয়। সবাই শহীদ স ম আলাউদ্দিনের ইমেজটাকে ব্যবহার করতে চায় কিন্তু তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকীর অবর্তমানে সবচাইতে সুবিধাজনক স্থানে ছিলেন সাবেক সাংসদ প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান । তিনি তালার লোক, তিনি যে তার জন্য অনেক কিছু করেছেন সেটা বলা যাবে না। শহীদ আলাউদ্দিন স্মৃতি সংসদটি পাটকেলঘাটা কেন্দ্রিক না করে জেলাব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যায়। মিঠাবাড়ীতে তিন দিনের আলাউদ্দিন মেলা করা যায়। জেলাব্যাপী তার অগণিত ভক্ত অনুরাগী, রাজনৈতিক সহকর্মীরা তাকে স্মরণ করবে। তার জীবনী বুকলেট আকারে জেলাব্যাপী স্কুল, কলেজে বিতরণ করা যায়।

তিনি সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি এবং পরবর্তীতে সভাপতি, ভোমরা স্থল বন্দর ব্যবহারকারী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এফবিসিসিআই’র কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের জেলা সভাপতি, বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির যুগ্ম-আহবায়কসহ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি, জেলা উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতি সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। স ম আলাউদ্দিন যে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সেই শিক্ষাকতার ধারা অব্যাহত রাখতে মৃত্যুর পূর্বে প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক স্কুল এন্ড কলেজ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়)। তিনি ঐ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। মৃত্যুর এক বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক পত্রদূত। তিনি পত্রদূত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক।

মুক্তিযোদ্ধা স ম আলাউদ্দিনকে হত্যার ঘটনায় নিহতের ভাই স ম নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ১০ মে সিআইডি’র খুলনা জোনের এএসপি খন্দকার ইকবাল হোসেন সাতক্ষীরার চিহ্নিত সন্ত্রাসী গডফাদারসহ ১০ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। যদিও বিভিন্ন আইনত জটিলতা সৃষ্টি করে প্রায় ১৪ বছর চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে বন্ধ ছিল। তবে গত ২০১১ সালে মামলাটির পুনরায় বিচার শুরু হয়। ৩৭জনের মধ্যে ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য সম্পন্ন হয়েছে। তবে মামলার আসামিদের প্রভাব এবং সাক্ষীদের নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণে গত কয়েকটি তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে কোন সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারেনি। ইতোমধ্যে আদালত সাক্ষীদের বিরদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেছে। মামলার শুরুতেই এই মামলার আসামিদের জামিন না দেওয়ায় আসামিদের সন্ত্রাসী বাহিনী সাতক্ষীরার দায়রা জজসহ ১৪ জন বিচারককে ছয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। সে সময় প্রশাসন ও পুলিশ আসামিদের জামিন দেওয়ার জন্য বিচারকদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। একপর্যায়ে বিচারকদের মুক্ত করতে বিডিআর গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যা পরবর্তীতে পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হয়। এমনকি বিচারকরা সভা করে ঐ ঘটনার নিন্দাসহ তাদের নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছিলেন। সংগত কারণেই মামলার সাক্ষীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার। এর আরো একটি কারণ হত্যা মামলার আসামিরা শুধু প্রভাবশালীই নয় প্রশাসন বিভিন্ন সময়ই তাদের আজ্ঞাবাহের মত কাজ করেছে। চোরাচালান এবং হাজার হাজার একর সরকারি খাস জমি ভোগ দখলের সুযোগ করে দিয়ে বিপুল পরিমান টাকাও কামিয়েছে প্রশাসনের দুর্নীতি পরায়ন সরকারী কর্মকর্তারা। তারপরও সাতক্ষীরার সর্বস্তরের মানুষ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে। বিচারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে দীর্ঘসময় আজো সাতক্ষীরার মানুষ এই জেলাকে খুনি ও সন্ত্রাসী মুক্ত করতে এই হত্যা মামলার বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। প্রশাসনে খুনিরা দাপুটে হওয়ার পরও ১০ আসামির প্রায় সকলেই সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ অভিযানগুলোতে ঘরে ঘুমাতে পারেনি গত প্রায় তিন দশক। কারণ এই একটি মামলা নয়, আসামি প্রায় সকলেই অসংখ্য মামলার আসামি এবং সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তালিকাভুক্ত চোরাকারবারী, সন্ত্রাসী, গডফাদার।

উল্লেখ্য, স ম আলাউদ্দিন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত ১০ জন আসামির মধ্যে অন্য একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও অসংখ্য মামলার আসামি সাইফুল্লা কিসলু ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। তার ম্যানেজার আতিয়ার রহমান হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এখনো পলাতক রয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কাটারাইফেলসহ গ্রেপ্তারকৃত আসামি সাইফুল ইসলাম যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় জামিনে মুক্ত রয়েছে। অপর আসামি আব্দুর রউফও একটি হত্যা মামলায় সাজা খেটে কয়েক বছর আগে জেল থেকে বের হয়েছে। আসামি এসকেন পালিয়ে বিদেশে চলে গেলেও কয়েক বছর পূর্বে দেশে ফিরে এই হত্যা মামলায় কয়েকদিন জেল খেটে জামিনে রয়েছে। অপর একটি হত্যা মামলায় সাজা খেটে বর্তমানে এই হত্যা মামলায় জামিনে রয়েছে আসামি শফিউল ইসলাম। তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আবুল কালাম, মোমিন উল্লাহ মোহন, শীর্ষ সন্ত্রাসী গডফাদার আব্দুস সবুর ও খলিলউল্লাহ ঝড় জামিনে রয়েছে। আগামি ২০ মার্চ এ মামলার পরবর্তী ধার্য দিন।

শহীদ স ম আলাউদ্দিনের হত্যাকারীরা যতই শক্তিশালী ও অর্থশালী হোক না কেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের বিচার ও রায় বাস্তবায়ন করতে প্রায় ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অশুভ শক্তি পরাজিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয় হয়েছে। আমরা সাতক্ষীরাবাসি শহীদ স ম আলাউদ্দিনের হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ের অপেক্ষায় রইলাম।


(অ/মার্চ ০৬, ২০১৪)