কাজী নজরুল ইসলাম, শরীয়তপুর থেকে :

অবশেষে দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মানের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে অচিরেই। ফলে বাপ-দাদার ভিটে মাটি ছেরে অন্যত্র চলে যেতে হচ্ছে স্থানীয়দের। পদ্মা সেতুর জাজিরা পয়েন্টে দুটি পূনর্বাসন এলাকা নির্মান করা হলেও একটিতে রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা অপরটির বাসিন্দারা কাটাচ্ছে মানবেতর জীবন। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশে পুরোনা ঘর বাড়ি ভেঙ্গে এখন খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ছে বৃষ্টিতে ভিজছে শতাধিক পরিবার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শরীয়তপুরের জাজিরায় প্রায় ১ হাজার ১ শত একর জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। সেতু নির্মানের কন্সট্রাকশন স্টক ইয়ার্ড, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, পদ্মা রিসোর্ট এলাকা, টোল প্লাজা, রেল ষ্টেশন ও দুটি পূনর্বাসন কেন্দ্র নির্মান করা হবে অধিগ্রহনকৃত এ ভূমির উপর। নির্ধারিত কাজ গুলোও এগিয়ে চলেছে পুরোদমে। শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও মুন্সীগঞ্জ উপজেলায় মোট ৬ টি পূনর্বাসন কেন্দ্র নির্মান করা হয়েছে। এর মধ্যে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে রযেছে দুটি। ২টি পূনর্বাসন এলাকার মধ্যে একটি রয়েছে জাজিরার পশ্চিম নাওডোবা ইউনিয়নে এবং অপরটি পূর্ব নাওডোবা মাঝিরঘাট এলাকায়। পশ্চিম নাওডোবা পূনর্বাসন কেন্দ্রে আড়াই শতাংশ, ৫ শতাংশ ও সাড়ে ৭ শতাংশ করে তিনটি ক্যাটাগরিতে প্লট রয়েছে ৫১৪টি। এ পূনর্বাসন কেন্দ্রটি নির্মান করা হয়েছে সম্পূর্ন আধুনিকতার আদলে। এখানে সকল প্রকার নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির একটি ছাপ পাওয়া যায়। অপর দিকে মাঝিরঘাট পূনর্বাসন কেন্দ্রে রযেছে ৫৫২টি প্লট। নাওডোবা কেন্দ্রের অধিকাংশ প্লটপ্রাপ্ত অধিবাসিরা তাদের প্লট বুঝে নিলেও মাঝিরঘাট কেন্দ্রে বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ৪ জন। এলাকাবাসী বলেছেন এক সময় তাদের ফসলী জমি ছিল, গৃহস্তালি ছিল, গবাদীপশু হাস মুরগী পালন করতো। এখন পূনর্বাসনে যতটুকু জমি দেয়া হয়েছে তাতে ঘর তুললে বারান্দা তোলার জায়গা থাকছেনা। ভবিষ্যতে কোন গৃহস্তালি করারও সুযোগও থাকবেনা।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, মাঝিরঘাট পূনর্বাসন কেন্দ্র সংলগ্ন কন্সট্রাকশন ষ্টক ইয়ার্ড এলাকার বাসিন্দারা আগে থেকেই জানতেন তাদের অধিগ্রহনকৃত জমি-বাড়ি এক সময় ছেড়ে দিতে হবে। তার জন্য তারা আগাম নোটিশও পাবেন। কিন্তু হঠাৎ গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোন রকম নোটিশ প্রদান ছারাই আইন প্রনেতা এক জনপ্রতিনিধি ও শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন স্ব-শরীরে হাজির হয়ে এলাকাবাসীকে জানালেন, ১০ দিনের মধ্যে যার যার ঘর ভেঙ্গে পূনর্বাসন কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে। কারন, পদ্মা সেতু নির্মানের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না ব্রীজ কর্তৃপক্ষ তাদের নির্মান সামগ্রী নিয়ে ৩০ জুনের মধ্যে এ ষ্টক ইয়ার্ডের দখল নিবে। এলাকাবাসী রমজান মাস পর্যন্ত তাদের বসত বাড়িতে থাকার অনুমতি চাইলেও জেল জরিমানার ভয় দেখিয়ে ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে সরিয়ে নিতে তাদের বাধ্য করা হয়। একদিকে রমজান মাস আরেক দিকে টানা বর্ষনের মধ্যে লোকজনেরা তাদের ঘর ভাঙ্গতে শুরু করে। এলাকায় কাঠ মিস্ত্রির সংকট থাকায় উচ্চ মুজুরী হারে গোপালঞ্জ জেলা থেকে মিস্ত্রি এনে ঘর পূনস্থাপন করছে। পূনর্বাসন এলাকায় যারা ঘর তুলছে তাদের কারো নামেই নির্ধারিতভাবে প্লট বরাদ্দ হয়নি এখনো। তার পরেও এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি যাকে যেভাবে যেখানে দেখিয়ে দিচ্ছে সে সেখানেই ঘর তুলছে। অদুর ভবিষ্যতে এই বসতি আবার সড়িয়ে নেয়া লাগতে পারে বলেও আশংকা এলাকাবাসীর। সরকারের সিদ্ধান্ত মতে যারা তাদের ঘর স্থানান্তরিত করবে তাদের ঘর ভাঙ্গা এবং স্থানান্তর করা উভয়রেই খরচ সরকার বহন করবে। এর জন্য প্রতি বর্গ ফুটে ১৭ টাকা হারে প্রদান করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ২ শতাধিক পরিবার তাদের ঘর বাড়ি সড়িয়ে নিয়ে পূনস্থাপন করলেও সরকার তাদের একটি টাকাও পরিশোধ করেনি এখনো। পূনর্বাসন এলাকায় পানি, বিদ্যুৎ, শৌচারগার, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব থাকার কথা থাকলেও কিছুই স্থাপন করা হয়নি এখনো। ফলে অন্তত দুই শতাধিক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে এ পূনর্বাসন কেন্দ্রে।

হাজী মোহর আলী মাদবর কান্দি গ্রামের কদম আলী শেখ এর স্ত্রী ফয়জুন নেছা, জাহাঙ্গীর হোসেনর স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য সরকারের হাতে আমাদের সবটুকু স্থাবর সম্পদ হস্তান্তর করেছি। ৪/৫ বার করে আমাদের বাস্তু ভিটা সরাতে হয়েছে । তার পরেও এখনো আমাদের নামে পূনর্বাসন কেন্দ্রে এক চিলতে প্লট জোটেনি । আমরা এখন কোথায় যাব।

হাজী সলিমুদ্দিন মাদবর কান্দি গ্রামের নেছার উদ্দিন টেপা, আবুল হোসেন বেপারী, আব্দুল লতিফ ফকির কান্দি গ্রামের আব্দুল মজিদ সরদার বলেন, আমাদের সাত পুরুষের ভিটে মাটি, ফসলী জমি সব কিছুই সেতু নির্মানের জন্য ছেরে দিয়েছি। এখন পূনর্বাসন কেন্দ্রে আমাদের কাউকে আড়াই শতাংশ কাউকে ৫ শতাংশ জমির উপর ঘর তোলার জন্য মৌখিক অনুমতি দেয়া হয়েছে। এত কম জায়গায় ঘর তুললেও বারান্দা দিতে পারছিনা। তোন গবাদি পশু পালন করতেও পারবো না, পারবো না একটু সব্জি চাষ করেও খেতে। আমরা এখন পরেছি উভয় সংকটে।

নাওডোবা ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আব্দুল লতিফ ফকির বলেন, আব্দুর বর সরদার, জয়নাল আবেদীন ঢালী ও ক্ষতিগ্রস্ত ইদ্রিস আলী মুন্সি বলেন, প্রশাসনের লোকেরা এবং আমাদের এমপি সাহেব ১০ দিনের সময় বেধে দিয়ে আমাদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে আমাদের পুরোনো ঘর ভেঙ্গে পূনর্বাসনে ঘর তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু প্রায় দুই মাস সময় পার হয়ে গেলেও আমাদের জন্য কোন কিছুই করা হয়নি এখনো। আমরা অনেক পরিবার এখনো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি। পয়োনিষ্কাশনের সমস্যা এখন প্রকট। খাবার পানি ও গোসল করারও সমস্যা । আমরা যেভাবে এখানে আছি তাতে বস্তির চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছি। তারা আরো বলেন, আমাদের কারো নামে এখনো প্লটের দলিলপত্র দেয়া হযনি। যেখানে ঘর তুলছি সেখান থেকে কয়দির পরে তাড়িয়ে দিলে আমরা কোথায় যাব।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রাম চন্দ্র দাস বলেন, আমরা শুধুমাত্র সেতু বিভাগের নির্দেশ ও পরামর্শ মোতাবেক তাদের সহায়তা প্রদানের মত দায়িত্ব পালন করছি। পূনর্বাসনের বিষয়ে সকল সিদ্ধানই গ্রহন করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। যাদের নামে প্লট বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে, তাদের থেকে এখনো কোন অভিযোগের আমার দপ্তরে আসেনি।

(কেএনআই/অ/জুলাই ২৩, ২০১৪)