শিক্ষাক্ষেত্রে শেখ হাসিনার প্রশংসনীয় নির্দেশনা
রহিম আব্দুর রহিম
গত ১৩ মার্চ জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্য বলেন, ‘শিশুদের শিক্ষার জন্য অতিরিক্ত চাপ দেওয়া উচিত না। তাদের পড়া-শোনাটা তারা যেন খেলতে- খেলতে, হাসতে- হাসতে সুন্দর করে নিজের মতো করে নিয়ে পড়তে পারে সেই ব্যবস্থাটাই করা উচিত। সেখানে অনবরত পড় পড় পড় বলাটা বা তাদের ধমক দেওয়া, চাপ প্রয়োগ করায় শিক্ষার উপর তাদের আগ্রহটা কমে। একটা ভীতি সৃষ্টি হবে। সে ভীতিটা যেন সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের আমি অনুরোধ করবো।’
তাঁর বক্তব্যের সার-সংক্ষেপ হলো, ‘অতিরিক্ত চাপে শিশুদের মধ্যে যেনো কোন প্রকার ভীতির সৃষ্টি না হয়। শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে আনন্দঘন। যেখানে শিশুরা খেলার ছলে শিক্ষা অর্জন করবে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে, প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা সত্যি প্রশংসনীয় এবং গবেষনালব্দ। যা উন্নত বিশ্বের সাথে সাম্ঞ্জস্যপূর্ণ এবং শিশু বান্ধব। অর্থ্যাৎ (Reading for pleasure) আনন্দের জন্য পড়া-শোনা।
প্রশ্ন, তবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মূল্যায়ন ধারা কি হবে? জাপানে শিক্ষা ব্যবস্থায় আগে ‘নীতি’ পরে ‘শিক্ষা’ সেই দেশে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত অর্থ্যাৎ ১০ বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিশুকে শিক্ষা নামক প্রতিযোগিতায় নামতে দেওয়া হয় না।অর্থ্যাৎ পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় না। তবে তাদের মূল্যায়ন করা হয়। শিশুদের যৌক্তিক ও গবেষনালব্দ শিক্ষায়, নীতি- নৈতিকতায় যুক্ত হয় ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও ন্যায়পরায়নতা। আমরা জানি, তিনটি যোগ্যতা অর্জনকারী একটি প্রাণই পূর্ণাঙ্গ মানুষ।
তার প্রথমটা ‘শারীরিক’ যা অর্জন হয় প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে। যাকে আমরা ফরমাল শিক্ষায় শিক্ষিত বলি। এক্ষেত্রে শিশুরা লাফ-ঝাঁপ, দৌড়া-দৌড়ি, হাঁটা-চলা, খেলা-ধুলার মাধ্যমে অর্জন করে থাকে। দ্বিতীয় যোগ্যতা ‘মানসিক’ অর্থ্যাৎ এবার শিশুটি ‘ভাল-মন্দ’ বুঝতে শেখবে, যা শেখতে হলে বাস্তবতার সাথে শিশুটি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে। জগত সৃষ্টি করতে পারবে।
তৃতীয়টি, ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’,যা অর্জন করতে শিশুটিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিশুটিকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। এই সময়ের মধ্যে শিশুটিকে মূল্যায়ন করতে, শিক্ষকদের পর্যবেক্ষন পদ্ধতি অবলম্ভবন করলেই চলবে। শিক্ষার্থী নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে আসছে কি না, সে খেলা ধূলায় অংশ নেয় কি না, বন্ধুদের সাথে মিশতে পারছে কি না, পড়া-লেখা পারে কি না, শিক্ষকদের সাথে কথা-বার্তা বলছে কি-না? অথ্যাৎ একক এবং দলীয় কাজে শিশুটি কতটুকু সর্ম্মাট, এটুকু হলেই শিশু শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন যথাযথ।
তবে এই শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচির সাথে একটি মূল্যায়ন ডায়রি রাখতে হবে। যে ডায়রি প্রতিদিন অথবা সপ্তাহিক মূল্যায়ন মার্কস শিক্ষক প্রদান করবেন। বছর শেষে নম্বর যোগ হয়ে শিক্ষার্থীর সার্বিক মূল্যায়ন মানদন্ড নির্মিত হবে। শিশু শিক্ষায় সরকার যে, পিইসি পরীক্ষা চালু করেছেন, তা যৌক্তিক। এতে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এক সময় লেখা-পড়া করুক আর না করুক, নাম লেখতে পারলেই পঞ্চম শ্রেণি পাস সার্টিফিকেট পাওয়া যেত। এখন তা আর সম্ভব নয়। এই পরীক্ষা আরও সহজ এবং ভীতিমুক্ত করা গেলে শিশু শিক্ষার উম্মুক্ত দ্বার উম্মেচিত হবে। এক্ষেত্রে সারা দেশের সকল প্রকার অর্থ্যাৎ কিন্ডার গার্ডেন, ইংরেজি মাধ্যম কিংবা মাদ্রাসার শিশু শিক্ষার পদ্ধতি এবং মূল্যায়ন দন্ড একীভূত প্রক্রিয়া করায় প্রতিষ্ঠানিক রুপ নিশ্চিত করাটাই যৌক্তিক।
প্রাথমিক স্তর পার হওয়ার পর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখাও জরুরী। এক্ষেত্রে পাঠ্যসূচির সাথে ফরমাল শিক্ষা সমান্তরাল করায় গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান সরকার, কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোয়ালিটি এডিকুশনকে গ্রহণ করতে একজন শিক্ষার্থীকে পারিপার্শ্বিক এবং আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষাপটের সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষত্রে ফরমাল শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তাও আবশ্যিক। বিষয়টি নিয়ে সেমিনার, আলোচনা ও পর্যালোচনা হতে পারে।
তবে প্রধানমন্ত্রী যেহেতু শিশু শিক্ষায় গবেষণালব্ধ, উন্নতি বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু করতে চাচ্ছেন; তাতে করে শিক্ষার মূল্যায়নের মানদন্ড আন্তর্জাতিক মানের হওয়াই উচিত। এক্ষেত্রে জিপিএ পদ্ধতি বিলুপ্ত করে জাপানের পদ্ধতি গ্রহণ করা যায় কি না? । জাপানের মূল্যায়নের মানদন্ড এর মধ্যেExcellent (চমৎকার) Good (ভাল)need more improvement আরো অধিক উন্নতির প্রয়োজন।
বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতির যে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত ভাল। তবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই পদ্ধতি না থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। যে ছেলেটি ষষ্ঠ,সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে সৃজনশীল পদ্ধতি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ অথবা ৪,৩ পেয়েছে, সেই ছেলেটি তার প্রতিষ্ঠানের উপর একটি রচনা লেখতে অক্ষম। কারণ কি ? যে বয়সে যা শেখানো দরকার তা শেখাতে আমরা যেমন ব্যর্থ, তেমনি কোন শিক্ষায় কি পদ্ধতি হওয়া চালু করা উচিত তা নির্ণয় করতেও আমরা অযোগ্য। পৃথিবীর সকল উন্নত দেশ গুলোতে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বিনিযোগ ও বিশেষ দৃষ্টিতে সরকার বদ্ধ পরিকর। আমাদের বর্তমান সরকার প্রধান যথেষ্ট আন্তরিক এই বলে যে,দেশের শিক্ষার মান উন্নত এবং জনমানুষকে জন শক্তিতে রুপান্তর করতে বদ্ধ পরিকর।
দুঃখজনক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রীরা শুধু প্রাইভেট কোচিং - এর বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ ব্যতিত, শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে কোন গবেষনালব্দ প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করতে পারেন নি। দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিনত করতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অতিদ্রুত জাতীয়করণ করা দরকার। এতে করে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রোধ এবং জবাব দিহীতা শতভাগ নিশ্চিত হবে। একই সাথে গতানুগতিক শিক্ষা নয়, উন্নত বিশ্বের সাথে সাম্ঞ্জস্যর্পূণ জন সম্পদ তৈয়ারের শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু করার প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দায়ী।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই সু শিক্ষিত জাতিও জনসম্পদ সৃষ্টিতে শিক্ষাখাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ চালু করে গেছেন। এক সময়কার মুষ্টির চালে পরিচালিত মাদ্রাসা শিক্ষকদের সর্বপ্রথম মাসিক পাঁচ টাকা হারে বেতন ভাতাদি চালু করেন, বর্তমানে ওই শিক্ষকরা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জীবন যাত্রা অতিবাহিত করার মতো বেতন ভাতাদি পাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু একযোগে ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছিলেন। এরপর কোন সরকারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণের মতো মহৎ কাজে এগিয়ে আসতে পারেন নি; যা করতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার। যে সরকার, একযোগে ২৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেন।
সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান, এক শিক্ষক সমাবেশে বলেছিলেন,‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে আগ্রহী। তিনি জানতে চেয়েছেন, সারা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে কি পরিমান অর্থের প্রয়োজন?’ প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ আর আলোর মুখ দেখেনি। অর্থ্যাৎ সংশ্লিষ্টরা তা আর প্রধানমন্ত্রীর ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেন নি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে বর্তমান সরকার শতভাগ সম্মানী ভাতা প্রদান করছেন। শুধু মাত্র মেডিকেল, আবাসিক এবং উৎসব ভাতায় বৈষম্য বিরাজ করছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়-সম্পত্তি,আয়-রোজগার রাষ্ট্রীয় খাতে নিয়ে; সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসাবে, তেমনি শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতির পিতার চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক।