বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন


বস্তুত কবিতার দিন শেষ! কবিতা আর এখন শিক্ষার্থীকে সমৃদ্ধ করার জন্য নয়। ছাত্রজীবনে মুখস্ত করে নিজস্ব ঢং-এ বলার জন্য নয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে মুখস্ত দশটি লাইন লেখার কথা আর বলাও থাকে না। তার মানেই হলো- কবিতার প্রতি দারুণ অবিচার।

একটু পেছনে ফিরে যাই? মনে করুণ আপনার শৈশবের কথা। কারণ প্রত্যেকেই একটি সোনালী শৈশব থাকে - নিজস্ব মনের অন্তঃপুরে। সেইখানে নিভৃতে আপনাকে কবিতা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বলা হলে কিছু রোমাঞ্চকর স্মৃতি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ছুটে আসবে। তার মধ্যে দেখা যাবে- মা, আমাদেরকে বাতাস করতে করতে সেই সময়ে কবিতা/ছড়া আওড়াচ্ছেন। মায়ের সুললিত সেই কণ্ঠধ্বনিটি জীবনের সেরা একটি স্মৃতিচারণমূলক মুহুর্ত হয়ে আজও আমাদের হৃদয়ের মনিকোঠায় রয়ে গেছে। কিন্তু আজ আমাদের নতুন প্রজন্মে পাঠ্যক্রমে কবিতার দিন শেষ!

একরাশ হতাশা ভর করছে এই কথাটি বলতে; তবু বলতেই হয়। এখনকার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে কবিতা মুখস্ত আর করতে হয় না। শিক্ষার্থীরা ভুলে গেছে পাঠ্যবইয়ের কবিতা মুখস্ত করার বিষয়টি। শর্টকাট শিক্ষাব্যবস্থা কবিতা আর মুখস্ত করার ক্ষমতাকে চিরকালের জন্য ছুটি দিয়ে দিয়েছে। তবু কবিতাপ্রেমীদের কাছে কবিতা আজও জীবনীশক্তি। কালজয়ী কবিতায় কাটে বিষন্নপ্রহর।

অথচ, একটি প্রিয় কবিতা মুখস্ত হলে- তা আমাদের মনোজগতে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে উঠে। অচেনা বিষন্নতার কোনো প্রহরে সেই প্রিয় কবিতার একটি প্রিয় লাইন আমাদেরকে পরম স্বস্তিময় করতে তুলতে পারে। হঠাৎই তখন মনে হতে পারে- এই ক্ষণটিকে এতো মধুময় মনে হচ্ছে কেন?

বলছিলাম- প্রিয় কোনো কবিতার লাইন মনের মাঝে হঠাৎ ফিরে আসার কথা। এরা অনর্গল এসে হৃদয়ে সুবাতাস দান করে চলে যায়। তারপর অন্য একটা লাইন আসে – অনুরূপ পথ ধরে।

মনে আছে- ‘সগির আলী’, ‘কেষ্ট দাস’, ‘মতলব মিয়া’ আর ‘রুস্তম শেখ’ এর কথা? এরা প্রত্যেকেই কিন্তু একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। নিজের কর্মপেশার ভেতর অবস্থান করে এরা প্রত্যেকেই যুদ্ধ করে গেছেন নিজের মতো। কবি শামসুর রাহমানের কালজয়ী কবিতা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’য় অমর হয়ে আছেন এরা।

মনে আছে- ‘স্বাধীনতা তুমি / রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।/ স্বাধীনতা তুমি /কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো / মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা’ এই কবিতাটির কথা? কী অপূর্ব শব্দধ্বনিতে রচিত! যতবার পড়া যায় ততবার কেবলি মুগ্ধতা।

কবির স্মৃতিচারণমূলক রচনা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে সপরিবারে কবি শামসুর রাহমান চলে যান গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। তখন চারদিকে যুদ্ধের দামামা। রক্তে রক্তে রঞ্জিত বাংলার সবুজ প্রান্তর। সেখানে এপ্রিলের প্রথমদিকে লিখে ফেলেন কালজয়ী ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতা দু’টি। এ দুই কবিতাই মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর গৌরবগাঁথা। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সংকটময় মুহূর্তগুলো যেন এখানেই নিদারুণ বেদনায় সুসজ্জিত।

‘স্বাধীনতার কবি’ শামসুর রাহমান (১৯২৯ – ২০০৬) ইতিহাসের যথার্থ ধারাভাষ্যকার হয়ে এই দুই কবিতাকে ‘কালজয়ী’ করে গেছেন তাঁর রক্তস্নাত বর্ণমালায়।

লেখক : সাংবাদিক ও আবৃত্তিশিল্পী।