স্টাফ রিপোর্টার : সমুদ্র সৈকতের জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করছে সাগরের পাড় ঘেঁষে গড়ে তোলা বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে সড়কে পর্য়টকদের ভ্রমণ ও যানবাহন চলাচল।

সড়কটির কলাতলী থেকে বেলী হ্যাচারির মোড় পর্যন্ত সংযোগ সড়কের সংস্কার কাজ চলার কারণে প্রায় দুই মাস ধরে এ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই সমুদ্র সৈকতের বালুচর দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে হচ্ছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটছে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা।

সড়কের বেহাল দশার কারণে সর্বশেষ শুক্রবার (৫ এপ্রিল) রাতে কলাতলী সৈকতের হোটেল সায়মান রিসোর্টের সামনে চিংড়ী পোনাবাহী একটি ট্রাক আটকে যায়। এতে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা মহাদুভোর্গে পড়ের ওই সড়কে চলাচলকারী পর্যটক ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের।

ভুক্তভোগীদের দাবি, গাড়ির অতিরিক্ত চাপ ও দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় পর্যটন নগরীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের বেহাল দশা হয়েছে। ফলে প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। এজন্য সড়কটি জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার প্রয়োজন।

জানা যায়, সড়কটির সংস্কার কাজ চালানোর জন্য গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনমাসের জন্য এ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কক্সবাজার পৌরসভা। এ বিজ্ঞপ্তিতে তিনমাসের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা বলা হলেও এরই মধ্যে বিজ্ঞপ্তি জারির দুইমাস পেরিয়ে গেলেও এখনও প্রকল্পের ২৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি।

তবে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, বারবার প্রকল্পের ডিজাইন পরিবর্তন এবং সড়কের ড্রেন নির্মাণ ও এলাকাবাসীর জমি না ছাড়ার কারণে প্রকল্পের কাজে ধীরগতি বিরাজ করছে। তবে আগামী তিনমাসের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।

গত ৫ এপ্রিল সরেজমিনে দেখা যায়, বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪চারটা পর্যন্ত ৩০মিনিটে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত দেশি বিদেশি সংস্থা এবং পর্যটকবাহী মোট ৫৮টি প্রাইভেট গাড়ি চলাচল করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই কক্সবাজারমুখী।

এছাড়া চরম ঝুঁকির মধ্যে সমুদ্রের বালুচর দিয়ে চলাচল করেছে আরো অন্তত অর্ধশতাধিক সিএনজি অটো-রিকশা, ব্যাটারিচালিত টমটম।

টমটম চালক আব্দুর রহিম বলেন, এই রাস্তা দিয়ে একবার গাড়ি নিয়ে আসলে গাড়ির একমাসের জীবনহানি হয়। তবৃও কি করবো,নিরুপায় হয়ে আসতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিশ্চুক আন্তজার্তিক সংস্থায় কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, গাড়ি নিয়ে সমুদ্রের চর দিয়ে যাওয়ার অনূভুতি সত্যিই ভালো লাগার। কিন্তু পাশাপাশি আতঙ্কে থাকি কোন জায়গায় গাড়িটি আটকে যায়।

এ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন চলাচলকারী সাংবাদিক আহমদ গিয়াস জানান, মূলত পর্যটন বিকাশের জন্য মেরিনড্রাইভ সড়কটি তৈরি করা হলেও এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে এ সড়কের গুরুত্ব হাজারগুণ বেড়ে গেছে। ক্যাম্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিদিন প্রায় ১২শ প্রাইভেট গাড়ি এ সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।

তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, জোয়ারের সময় এখানে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। বিশেষ করে পূর্ণিমা-অমাবশ্যার সময়ে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে ওই সময় ১০ থেকে ১২দিন যানবাহন চলাচলে ঝুঁকি আরো বাড়ে। এতে স্থানীয়,পর্যটক এবং ক্যাম্পে কর্মরতদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে । এ ভোগান্তির বিষয়টি বিবেচনা করে পৌর কর্তৃপক্ষের উচিৎ এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা।

স্থানীয়রা বলছেন, কলাতলীর দক্ষিণে মেরিন ড্রাইভের ২ কিলোমিটারের মধ্যে দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কোনো হাইস্কুল নেই। তাই ওই অংশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে ওই সড়কটি পার হয়ে কলাতলী উত্তর অংশের স্কুলে আসতে হয়। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখায় প্রতিদিন প্রায় ছয় কিলোমিটারেরও বেশি পথ হেঁটে অথবা ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের স্কুলে যাতায়াত করতে হচ্ছে।

স্কুলগামী এসব শিশুর অভিভাবকদের মধ্যে নতুন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

অন্যদিকে, মেরিন ড্রাইভ সড়কটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় হিমছড়ি, দরিয়ানগর ও ইনানীর বিভিন্ন হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস ও পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক অস্বাভাবিকভারে পর্যটক কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

দুইমাসে সড়কের ২৫ শতাংশ সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়নি
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রের তীর ধরে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে ওঠা ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়কের উদ্বোধন হয় ২০১৭ সালের ৬ মে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়কটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

তবে ১৯৯১-৯২ সালে সড়ক প্রকল্পটি গ্রহণের পর থেকেই নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু মেরিন ড্রাইভের স্টার্টিং পয়েন্ট কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে বেইলী হ্যাচারি মোড় পর্যন্ত প্রায় ১৩শ’ মিটার সড়ক বিগত ২০০০ সালে সামুদ্রিক ভাঙনে বিলীন হয়ে গেলে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে সড়ক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

পরে ২০০৫-০৬ সালে কলাতলী গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সংকীর্ণ সড়কটিকে সামান্য প্রশস্ত করে মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সড়কটি সংস্কার না হওয়ায় সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় পৌরসভা।

পৌরসভার গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ককক্সবাজার শহরের কলাতলী ডলফিন মোড় অর্থাৎ মেরিন ড্রাইভের সম্মুখভাগ থেকে কলাতলী বেইলী হ্যাচারির মোড় পর্যন্ত ১.৩ কিলোমিটার সড়কের সংস্কার কাজ শুরু করার কথা গত ২ ফেব্রুয়ারি। ইউজিআইআইটি প্রকল্পের অধীনে অন্য আরো দুটি সড়কের সংস্কার কাজসহ প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি সংস্কারের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

কক্সবাজার পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী টিটন দাশ বলেন, পৌরসভার নিয়ম অনুযায়ী ৩৬৫দিনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হয়। কিন্তু ড্রেনের জন্য জমি নিয়ে জটিলতা এবং বার বার ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে সঠিক সময়ে কাজটি শেষ করা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন,এ প্রকল্পে প্রথমে ছিল শুধুমাত্র ১হাজার ৫০০ মিটার কার্পেটিং সড়ক। পরবর্তীতে মেয়র মহোদয়ের ইচ্ছার কারণে এটিকে কার্পেটিং থেকে আরসিসি ঢালাই সড়ক করা হয়। এর মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলে এলাকাবাসীর কাছ থেকে দাবি আসে সড়কের পাশে ড্রেন নির্মাণের। ড্রেনের জন্য জায়গা বের করতে গেলেই জটিলতা শুরু হয়। এলাকাবাসীর অনেকের সঙ্গে পৌর কর্তৃপক্ষের বিরোধ দেখা দেয় । এমনকি ড্রেনের জমি উদ্ধার করতে গিয়ে আমার উপর হামলাও চালনো হয়েছে। এসব কারণে মূলত সংস্কার কাজে ধীরগতি চলছে।

প্রকল্পের ২৫ শতাংশ কাজ হয়েছে জানিয়ে প্রকৌশলী টিটন দাশ আরো বলেন, আশা করছি, আগামী দুই-তিনমাসের মধ্যে পুরোপুরি কাজ শেষ করা যাবে।

(ওএস/এএস/এপ্রিল ০৬, ২০১৯)