স্টাফ রিপোর্টার : যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদের কারণে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মারা গেছেন। গত পাঁচ দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন নুসরাত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাতকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়ার নির্দেশ দিলেও শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে নুসরাতকে মৃত ঘোষণা করেন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।

সামন্ত লাল সেন জানান, নুসরাতের মৃত্যুর কারণ রক্ত ও ফুসফুসের মারাত্মক সংক্রমণ থেকে কা‌র্ডিও রেসপিরেটরি ফেইলিয়র (হৃদযন্ত্রে ক্রিয়া বন্ধ) হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

নুসরাতের মৃত্যুর খবর ফেনীতে ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকে টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নুসরাতের শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোসহ ও দোষীদের ফাঁসি দাবি জানিয়েছেন অনেকেই।

ফেসবুকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক লিখেছেন, 'সারা শরীরে তীব্র ব্যথা নিয়ে মেয়েটি বলেছিল 'আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই যাবো। আমার জীবন থাকতে যে অন্যায় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আমার সঙ্গে করেছেন, জীবন থাকতে সে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করবো না'.... ৮০ ভাগ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়েই সাহসের সঙ্গে মেয়েটি বলেছে- 'আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলবো, সারা পৃথিবীর কাছে বলবো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো..... অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে করতে তীব্র ব্যথা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো মেয়েটি। '

এছাড়া ফেসবুকে শেখ তাজউদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন, 'ঘুমিয়ে গেলি নুসরাত মা- বড্ড অস্থিরতায় আছি। প্রিয়জন হারানোর বেদনার মতো বুকটা ফাঁকা হয়ে আসছে। তবে কুৎসিত সোনাগাজীর (ফেনী) মানুষগুলোকে আর দেখতে হবে না তোকে মা। যারা তোকে হত্যার নেপথ্যে তাদের মুক্তির জন্য মিছিল করে সেই সব মানুষ রূপী জানোয়ারদের দেখতে হবে না। ঘুমিয়ে যাও, আর আমাদের ক্ষমা করো, আমরা কিছুই করতে পারিনি। কতটা কষ্ট সয়েছিস মা শেষ কয়টা দিন। আল্লাহ নুসরাত জাহান রাফিকে শান্তির ঘুম দাও।'

এমডি হানিফ লিখেছেন, 'আগুনে দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত রাত সাড়ে নয়টায় মারা গেছে 'ইন্নালিল্লাহি ওয়া লিল্লাহি রাজিউন' নুসরাতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি আল্লাহ যেন নুসরাতকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন... আমিন। পাশাপাশি নুসরাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে ফাঁসিতে ঝুলানোর জোর দাবি জানাই'।

কামাল উদ্দিন লিখেছেন, 'আল্লাহ এই বোনকে শহিদের মর্যাদা দিও। এই হত্যার সঙ্গে জড়িত কুলাঙ্গার সোনার ছেলেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।'

বরেণ্য লেখক স্বকৃত নোমান লিখেছেন, 'মধ্যযুগীয় বর্বরতা। কথাটি প্রায়ই শোনা যায়। মধ্যযুগ কাহাকে বলে? কতো সাল থেকে কতো সাল? মধ্যযুগের বর্বরতার ধরন কেমন ছিল? আমার মতো মনে হয় বর্তমানের চেয়ে মধ্যযুগ অনেক ভালো ছিল। আমরা বর্তমানকে অস্বীকার করি। বর্তমানের বর্বরতাকে ঢাকতে মধ্যযুগের তুলনা দেই। একটা মেয়েকে শিক্ষক নামধারী বদমাশ আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেললো। এরপর আর মধ্যযুগীয় বর্বরতা কথাটা চলতে পারে না। বিদায় নুসরাত জাহান রাফি। এই সমাজ তোমাকে বাঁচতে দিল না। সরকার, ওই মাদ্রাসা বন্ধ করে দিন এমপিওভুক্তি বাতিল করুন। মাদ্রাসা নামক এই জল্লাদ খানায় আর বিদ্যাশিক্ষা চলতে পারে না। গড়ে তুলুন নষ্ট সমাজ, নষ্ট মানুষের হাতে বলি হওয়া নুসরাতের নামে অন্য কোনো বিদ্যাপীঠ, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান। দানব সিরাজউদৌলার শাস্তি চাই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। হত্যার বদলে হত্যা। হত্যাকারীর ক্ষমা নাই।'

নুসরাতের মামলার আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু লিখেছেন, 'ফেনীর কৃতি সন্তান নুসরাত জাহান রাফি আর নেই। ইন্নালিল্লাহ। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ও পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আইনজীবী হিসেবে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাব এ প্রতিজ্ঞা করছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।'

শওকত ওসমান ভিপি লিখেছেন, 'ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। নুসরাতের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তার হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে কঠিন ব্যবস্থা নিবেন বলে আমরা আশা করি।'

সাংবাদিক বখতেয়ার মুন্না লিখেছেন, না ফেরার দেশে চলে গেলো ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত। হায়নাগুলো তোকে বাঁচতে দিলো না। এ সমাজ তোকে বাঁচাতে পারলো না। এ সমাজ কখনও সিরাজউদৌলার মত হায়নাদের রুখতে পারবে না? আল্লাহ তোকে বেহেশত দান করুক।'

গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার কেন্দ্রে গেলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। এর আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে করা যৌন হয়রানির মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় তারা।

এই ছাত্রীর পরিবারের ভাষ্যে, ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা তার কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। তারই জেরে মামলা করায় নুসরাতকে আগুনে পোড়ানো হয়। ওই মামলার পর সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

(ওএস/এএস/এপ্রিল ১২, ২০১৮)