শরীয়তপুর প্রতিনিধি : মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সাড়ে তিন বছরের শিশু জিহাদুল ইসলাম জিহাদ দিনরাত ছটফট করছে মৃত্যু যন্ত্রনায়। পরিবারের দাবী হামের টিকা প্রয়োগের পরই ক্যান্সার আক্রান্ত হয় জিহাদ। দেশ-বিদেশে চিকিৎসা করিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে স্থানীয় সাংবাদিক দরিদ্র পিতা। টাকার অভাবে এখন আর চিকিৎসা চালাতে না পরায় একমাত্র সন্তানের দুঃসহ যন্ত্রনা নীরবে সহ্য করছেন অসহায় মা-বাবা।

জিহাদ শরীয়তপুর পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের স্বর্ণঘোষ দিঘীরপাড় এলাকার বাসিন্দা মো. ইয়াকুব বেপারী ও জান্নাতুন আক্তার ঝুমুরের একমাত্র সন্তান। ইয়াকুব বেপারী শরীয়তপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক হুংকার পত্রিকার রিপোর্টার এবং একটি অনলাইন পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি। ২০১৫ সনের ২৮ আগষ্ট পার্শবর্তি চিতলিয়া ইউনিয়নের চিতলিয়া গ্রামে মাতুতালয়ে জন্ম হয় জিহাদের।

জিহাদের মা-বাবা জানান, জিহাদুল জন্ম গ্রহনের পর ইপিআই টিকাদান কার্ডের (শিশু) মাধ্যমে চিতলিয়া ১ নং ওয়ার্ডের স্বাস্থ সহকারি মোক্তার হাওলাদারের মাধ্যমে ১৪-০৯-২০১৫ তারিখে নিবন্ধনভূক্ত করা হয়। নিবন্ধন নাম্বার-২(বহিরাগত)। এরপর থেকে বিসিজি, পেন্টা (ডিপিটি, হেপ-বি, হিব), পিসিভি, ওপিভি, আইপিভি, এমআর (হাম ও রুবেলা) ও হাম (২য় ডোজ) টিকাগুলো দিতে যান শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিতলিয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের টিকাদান কেন্দ্র ছাত্তার হাওলাদারের বাড়ি। সেখানে সবগুলো টিকাই প্রয়োগ করেন ওই কেন্দ্রের স্বাস্থ্য সহকারি মোক্তার হাওলাদার।

২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর হাম (২য় ডোজ) শেষ টিকাটিও জিহাদের ডান উরুতে প্রয়োগ করেন মোক্তার। ২/৩ মাস পর টিকা প্রয়োগের স্থানটি ফুলে গিয়ে সেখানে একটি গোটা (টিউমার) তৈরী হয়। এরপর জিহাদের মা-বাবা প্রথমে মোক্তারের কাছে যান। পরবর্তিতে তার পরামর্শে শরীয়তপুর সদর হাসপালের চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে গেলে তারা জানান, এটি হাম টিকার প্রভাবে হয়ে থাকতে পারে তবে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে অন্তত ৭-৮ মাস অতিবাহিত হলে জিহাদের ডান পায়ের উরুর মাংসপিন্ড শক্ত হতে থাকে।

পুনরায় জিহাদকে হাসপাতালে নিয়ে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. শেখ মোস্তফা খোকন, মেডিকেল অফিসার ডা. মিজানুর রহমান ও ডা. শামীম আব্দুল্লাহকে দেখান। তারা জিহাদুলকে ঢাকায় নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেখানোর পরামর্শ দেন। পরে জিহাদুলের বাবা-মা ঢাকা শিশু হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি), পঙ্গু হাসপাতাল ও সর্বশেষ ধানমন্ডি ইবনেসিনা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসা করান। সেখানে বায়োপসি নামের একটি পরীক্ষা করানোর পর চিকিৎসকরা জানান, জিহাদের ডান উরুতে ক্যান্সার ছড়িয়ে পরেছে। বাংলাদেশে এর চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ন। অপারেশন করা হলে সমস্ত শরীরে ক্যান্সারের জীবানু ছড়িয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের চিকিৎসকের পরামর্শে গত ১৩ জানুয়ারি জিহাদকে ভারতের তামিলনাড়– প্রদেশের ভেল্যুর সিএমসি হাসপাতালে নিয়ে যান জিহাদের মা-বাবা। সেখানে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ল্যানী গ্রেস ম্যাথিউ জিহাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে তিনি জানান, জিহাদকে চিকিৎসা করাতে হলে সেখানে ১৫ মাস অবস্থান করতে হবে। এতে শুধু চিকিৎসা ব্যয় হবে ভারতীয় মুদ্রার অন্তত ১০ লাখ টাকা । এরপর চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারায় জিহাদকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন ওর মা-বাবা।

সরেজমিন জিহাদদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ক্যান্সার আক্রান্ত জিহাদুল ইসলাম জিহাদের পুরো ডান পা‘টি অস্বাভাবিকভাবে ফুলে মোটা ও শক্ত হয়ে গেছে। ২৪ ঘন্টাই শিশু জিহাদ কান্নাকাটি করছে। নিজে ঘুমোতে পারেনা মা-বাবাকেও ঘুমোতে দিচ্ছেনা। দুর্বিসহ মরণ যন্ত্রনার কথা কাউকে বুঝিয়ে বলতেও পারছেনা এই অবুঝ নিষ্পাপ শিশুটি। সন্তানের আর্তনাদে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মা-বাবা। পরিবারের অন্য লোকেরাও সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা আর কান্নাকাটি করছে বাড়ির সবচেয়ে কনিষ্ট সদস্যটির জন্য।

জিহাদুলের মা জান্নাতুন আক্তার ঝুমুর বলেন, আমার বাবার বাড়িতে জিহাদের জন্ম হয়। জন্মের পর একই গ্রামের বাসিন্দা আমাদের প্রতিবেশী মোক্তার হাওলাদারের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করে আমার ছেলেকে সব ধরনের টিকা দেই। কার্ডে মোক্তার হাওলাদারের স্বাক্ষর রয়েছে। সর্বশেষ হামের দ্বিতীয় ডোজ টিকাটি দেয়ার কিছুদিন পরই জিহাদুলের উরুতে সমস্যা দেখা দেয়। সেখান থেকেই ক্যান্সার হতে পারে বলে আমরা মনে করছি। আমার ছেলের পায়ে অন্য কোন আঘাত লাগেনি বা ক্ষত হয়নি কখনো। এখন যতই দিন যাচ্ছে ততই জিহাদের ডান পা ফুলে যাচ্ছে,সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। ব্যথায় আমার সোনার মানিক সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। একটু দাঁড়াতে বা বসতেও পারেনা। আমার ছেলের সুস্থতার জন্য সবার কাছে দোয়া ও সহায়তা চাই।

জিহাদের বাবা ইয়াকুব বেপারী বলেন, আমার একমাত্র সন্তানের চিকিৎসার জন্য আমি দেশের বিভিন্ন নামকরা হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছে টানা দুই মাস ঘুরে চিকিৎসা করিয়েছি। তাদের পরামর্শে ভারতের সিএমসি হাসপতালে এক মাসেরও বেশী সময় কাটিয়ে এসেছি। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করেছি। ভারতে ১৫ মাস রেখে চিকিৎসার জন্য বলেছেন সিএমসি‘র ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তাতেও অন্তত ৩০ লাখ টাকা লাগবে। কিন্তু এত টাকা আমি কোথায় পাব? টাকার অভাবে এখন ছেলের চিকিৎসার ব্যয় চালাতে পারছি না। এতটুকু নিষ্পাপ সন্তানের এই কষ্ট আমি সইতে পারছিনা। আমি আমার সন্তানের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে সহায়তা চাই, সকলের কাছে ওর আরোগ্য লাভের জন্য দোয়া চাই (ইয়াকুব বেপারীর ফোন নাম্বার : ০১৯১৭-৩৮৭০১০/ ০১৭৯৩-৩৬৩৮২৫)।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিতলিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের স্বাস্থ্য সহকারী মোক্তার হাওলাদার বলেন, জিহাদুলকে আমি হামের দ্বিতীয় ডোজের একটি মাত্র টিকা দিয়েছি। অনেক শিশুকেই টিকা দিয়ে থাকি। টিকার কারণে জিহাদুলের সমস্যা হওয়ার কোন কারন আছে বলে আমি মনে করিনা। অন্যকোন কারনেও ওর শরীরে এই রোগ হতে পারে।

শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন ডাক্তার খলিলুর রহমান বলেন, জিহাদুল ইসলাম নামে একজন শিশু ক্যান্সার আক্রান্ত হবার বিষয়ে তথ্য পেয়েছি। মানব দেহে যে কোন কারনেই ক্যান্সার বা অন্য কোন রোগ হতে পারে। কিন্তু সরকারি কর্মসূচির কোন টিকা থেকে ক্যান্সার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই এমনকি বাংলাদেশে এর কোন প্রমানও নেই।

(কেএনআই/এসপি/এপ্রিল ১৩, ২০১৯)