বৈশাখ একান্তই বাংলার ঋতু,আর এই বৈশাখের প্রথম দিনটি সাড়ম্বরে পালিত হয় গোটা বাংলাদেশে নববর্ষ উৎসব হিসেবে। তাই বাংলা কবিতা বিপুল বর্ণবৈভবে বৈশাখকে ধারণ করবে- এতে আর সংশয় কী। বৈশাখেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর তিনিই যখন তাঁর জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখকে শব্দরঞ্জিত করে গেছেন তখন বৈশাখী পঙ্ক্তি রচনার জন্যে বাংলার আবেগপ্রবণ কবিকুলের প্রেরণার অভাব ঘটে না।কেবল নিজ জন্মক্ষণটিকে কবিতায় বেঁধে রাখার জন্য নয়, রবীন্দ্রনাথকে এই রচনায় স্মরণ করতে হবে আরো একটি উপলক্ষে।সেটি হলো বৈশাখের রূপরসগন্ধ নিয়ে তিনি প্রচুর কবিতা ও গান রচনা করে গেছেন, যেগুলো শতবর্ষ পেরিয়েও বাঙালিকে পড়তে ও গাইতে হচ্ছে। বলা অসংগত নয় যে, বৈশাখ নিয়ে যে-লেখাগুলো কালজয়ী হয়েছে, আমার বিবেচনায় তার বেশির ভাগই রবীন্দ্রনাথের অবদান।বৈশাখকে তিনি অবলোকন করেছিলেন একদিকে ‘মোহন ভীষণ বেশে’, অন্যদিকে দেখেছেন ‘অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া মৌনী তাপসরূপে’।আমাদের আজকের এই লেখার প্রাসঙ্গিক কবিতা-বিবেচনার কালসীমানার শুরু অবশ্য একাত্তর সাল থেকে, তবু রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ এড়ানো যায় না। এক পঙ্ক্তিতে নজরুলের নিবেদনকেও সম্মান জানাতে হবে; বৈশাখের স্বকীয় স্বরকে তিনি বাংলা বর্ণ ব্যবহার করে সমধ্বনি সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন।বৈশাখের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো ‘বৈশাখী ঝড়;সেই ঝড়ের আওয়াজ বাতাসের শনশন ক্বড় ক্বড় শব্দে শব্দে গেঁথে তোলায় তাঁর মতো কে আর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।


চেনা বৈশাখের ভিন্নতর অবয়ব বাংলা কবিতায় কীভাবে এসেছে, বৈশাখের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেও কবিতায় অভিনব কী অনুভূতি সংযুক্ত হয়েছে- তার অনুসন্ধান বরং অধিক গুরুত্বপূর্ণ।শত শত বছর ধরেই বাঙালি কবির কাছে বৈশাখ একটি অনিবার্য প্রসঙ্গ। পঞ্চাশ ও ষাটের দুই প্রধান কবি তাঁদের আত্মপ্রকাশকারী কবিতাগ্রন্থের শিরোনামে স্থান দিয়েছেন বৈশাখের মুকুটকে;সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’এবং মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ বাঙালির চিরায়ত আবেগের সম্মানেই স্থিরীকৃত। নববাংলাদেশ কিংবা নববৈশাখ প্রাপ্তির পূর্বক্ষণে বাঙালির সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত কালপর্যায়টি হলো একাত্তর।রক্তেবারুদে মেশানো ওই আশ্চর্য সময়টি সত্যি সত্যি কাগজে কবিতার অক্ষর উৎকীর্ণ হবার মতো ছিল না,যদিও কবির মন ও মননের গভীরে মুক্তির শব্দাবলী গুঞ্জরিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক।মার্চের শেষ সপ্তাহে নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী সৈনিকেরা।রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল তারা।এর কিছুকাল পরেই বাংলায় ফিরেছিল বৈশাখ-দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক রুদ্রঋতু। কালের এই বিবরণ সোজাসাপ্টাভাবে উঠে এসেছে সমুদ্র গুপ্তের একটি কবিতায়- ‘যুদ্ধের প্রথম মাসে এসেছিল পয়লা বৈশাখ, মেঘের ডম্বরু ফেলে হাতে হাতে উঠেছিল,স্বাধীনতা যুদ্ধের বজ্রনিনাদ,যুদ্ধমুখী পা আর স্বাধীনতা দেখে ফেলা চোখ,আমাদের জেগে ওঠার,প্রথম সাক্ষী ছিল বৈশাখ মেঘ।’বাংলার যোদ্ধাকবি দেশজননীর কাছে তখন কী যাচ্ঞা করতে পারে?কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করছি যাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পূর্বেকার সকল সময়ের কবিদের বৈশাখ বিষয়ক কবিতা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্বরটি।স্বাধীনতার লক্ষ্যে লড়াইয়ের জন্যে বৈশাখ থেকে শক্তি সঞ্চয়ের এই আবেদন সত্যিই অনবদ্য।


বৈশাখের রুদ্র জামা আমাকে পরিয়ে দে মা
আমি তোর উজাড় ভাঁড়ারে বারুদের গন্ধে বুক ভরে নেব।এখন তোর ভীষণ রোগ,গা-য়ে চুলো গনগন করছে;আমাকে পুড়িয়ে দিলি মা।নাৎসী হাওয়া তোর পিদিমে ফুঁ দিতেই, চপচপ করে ভিজে গেল মুখ এত রক্ত কেন রে মা, এত রক্ত কোনোদিন আমি দেখিনি-দেখিনি মা
বৈশাখের রুদ্র জামা।


বলেছি বৈশাখ একান্তই বাংলার ঋতু, একে ঠিক তন্দুর-গহ্বর-তপ্ত এপ্রিলের সঙ্গে মেলানো যায় না।টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’,অন্যদিকে বাংলাদেশের বৈশাখ উৎসব-সূচিত দারুণ জঙ্গমদৃপ্ত একটি মাস।যদি বলি বৈশাখকে চিনতে পারার সংকেত কী? তবে নির্দ্বিধায় মিলবে উত্তর-খর রোদ এবং ক্ষিপ্র ঝড়। রোদ আর ঝড়- এদুটি উপাদান ব্যবহার বা প্রয়োগের ভেতর দিয়ে কবির স্বভাবও বিলক্ষণ অনুভব করা যায়। গনগনে রোদ্দুর বা সূর্যরশ্মি কবিতায় কখনো পায় লকলকে জিহ্বার তুলনা, কখনোবা পায় সোনালী অভিধা, কিংবা রুপোর তীরের মহিমা।দেখবার এই আলাদা আলাদা ধরনের কারণেই বাংলার বৈশাখী কবিতা অঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে আকর্ষণীয় অলঙ্কার। স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষে যে-বালক ধীরে ধীরে হবে সাবালক, সময় তাঁকে পরিণত করবে এক কবিকণ্ঠে, তাঁর সমীপে রোদ কী বারতা নিয়ে আসে?বৈশাখের খর রৌদ্র ঝিম মারা লাটিমের মতো,এসেছে প্রাণের মধ্যে স্মৃতির কুলুঙ্গি খুলে দিতে’।একটু অবাকই মানতে হবে যখন সতীর্থ অপর কবি রোদ নয়, বাতাসকে গুরুত্ব দেবেন, বলবেন-আত্মজীবনীর পাতা উড়ে যাচ্ছে বৈশাখের এলোমেলো পাগল বাতাসে।


বাতাস প্রসঙ্গে পরে যাব, তবু এখানে একটু বলে নেয়া যাক।রোম্যান্টিকতার আঘ্রাণ মিলবে সমবয়সী অপর কবিতার চরণে-পাপড়ির আড়ালে শত রেণু হয়ে ভেসে যাব বৈশাখের নিরুদ্দেশ বাতাসে বাতাসে।আবার এর বিপরীতচিত্রও রয়েছে যা পাঠে পাঠকের বিবমিষা জাগতে পারে।কারণ সূর্যকে রক্তমাখা সুগোল টিউমারের সঙ্গে তুলনা দিয়ে সূর্যরশ্মিকে বলা হয়েছে হলুদাভ পুঁজের ফিনকি।দৃষ্টির অভিনবত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কবিতার ন্যায্য দাবী যথাযথভাবে পূরণ না হওয়ায় আবিদ আনোয়ারের নয় পঙক্তির কবিতাটি গুরুত্ব বাড়ায়নি।তবে রৌদ্র কিংবা হাওয়ার কাছে কবির কামনা বা প্রার্থনার বিষয়টিও তাৎপর্যমণ্ডিত।তরুণমনের এমন উচ্চারণ শ্র“তিকে আনন্দ দেয়-‘বৈশাখের নগ্নখরায় ঝরাপাতাদের বিরহসঙ্গীত’।যদিও এখনও কোনো কোনো নবীন কবির অন্তরে সেই রবীন্দ্রনাথের বাণীরই ছায়া প্রবল;একটি উদাহরণ-‘বৈশাখের খররৌদ্রে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে উঠুক আমার পুণ্যভূমি’।এ যেন গঙ্গাজল দিয়ে গঙ্গাপুজো।শুরুতে রবীন্দ্রনাথের কথা এমনিতে বলিনি।বিশেষ করে বৈশাখ মৌসুমে বাংলার মানুষের রবীন্দ্রপ্রীতি সম্পর্কে সকল কবির হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের এক প্রধান কবি যখন জানিয়ে দেন;

আজ ধ্র“বতারা অস্ত গেল না
মঞ্চে ফুটে আছেন শুধু আপনি, রবিঠাকুর
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়, ঘর থেকে মুখর প্রাঙ্গণে আজ সারাদিন বর্ষবরণের যতো উৎসব হবে তার সব কটিতে প্রধান
নক্ষত্রপুরুষ আপনি,রবিঠাকুর।