ইমরান আহমদ জীবন : বছর ঘুরে আবারো আমাদের দুয়ারে এসে নাড়া কাড়ছে ঈদ। ঈদ আমাদের মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ আনন্দের দিন। সমস্ত মুসলিম জাতির জন্য প্রতি বছর দু’টি উৎসব নির্ধারিত। একটি পবিত্র ঈদুল ফিত্র অন্যটি ঈদুল আজহা। একটি মাস সিয়াম সাধনা শেষে ঈদুল ফিত্রের আগমন ঘটে। এ দিন শুধু আনন্দ-উৎসবের নয়, এ দিন সকল মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ ও সহনশীল হওয়ার দিন। বিভেদ-ভেদাভেদ ভুলে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সমস্ত মুসলিম জাতির একত্রিত হওয়ার দিন। এ দিন মিলেমিশে উদযাপন করতে দূরদূরান্ত থেকে স্বজনের সঙ্গে মিলন ঘটে।

ঈদ উপলক্ষ্যে আমাদের আনন্দ-আয়োজনের কোনো শেষ নেই। মুসলিম হৃদয়ে বয়ে যায় সীমাহীন আনন্দের বন্য। ঈদ আমাদের মুসলিম জাতির জন্য নিয়ে আসে অনাবিল সুখ ও শান্তির বার্তা। অতীতের দুঃখদুর্দশা ছুড়ে ফেলে সমস্ত মুসলিম জাতি একত্রিত হওয়ার আহ্বান নিয়ে ঈদ আসে। আমাদের মানবজীবনের ভেদাভেদ দূর করে ভাইয়ে ভাইয়ে, ছোট-বড়, গরিব-ধনী সবার সঙ্গে বুক মিলিয়ে জানান দেই-আমরা এক আল্লাহর সৃষ্টি, আমরা এক।

আমরা অনেকেই এই একটি দিনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে থাকি। আমাদের সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে বুকে বুক মিলিয়ে ভালোবাসার আহ্বান জানাই। ঈদ আমাদের জীবনে বয়ে আনে সুখ-শান্তি।

ঈদের চাঁদ উঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আনন্দের বাঁধ ভেঙে যায়। ছোট শিশু থেকে শুরু করে সবার মনে রঙের ফোয়ারা বয়ে যায়। তখন অপেক্ষা শুধু ঈদের দিনটির। ঈদের চাঁদ উঠার পর থেকে পাড়ামহল্লায় শোনা যায় শিশুদের হইহুল্লোড়। আনন্দে মাতোয়ারা থাকে ছোট শিশুরা। বড়রা ব্যস্ত থাকেন ঘর গোছাতে। সবার মনেই তখন আনন্দের ফোয়ারা। তখন থেকেই শুরু হয় ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা যায় দূর প্রবাসে থেকেও।

ঘরকন্যাদের ব্যস্ততাও বেড়ে যায় অতুলনীয়। ঘরদোর পরিষ্কার, হাঁড়িপাতিল ধোয়ামোছা, বাচ্চাদের কেনাকাটা, ঈদের বিশেষ আয়োজন, পিঠা তৈরি ইত্যাদিতে তাঁদেরও কোনো রেহাই নেই ব্যস্ততা থেকে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও দেখা যায় ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত থাকতে।

শহরে ঈদের আগের রাত অর্থাৎ চাঁদ রাতে আমাদের ব্যস্ততার সীমা থাকে না। চারদিকে মানুষের ছুটে চলা বেড়ে যায়। কে কার আগে কাজ গোছাবেন, কেনাকাটা করবেন, বাড়ি যাবেন-এ নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। আমাদের যান্ত্রিক জীবনে কয়েক দিনের জন্য সুখ জুড়ে বসে। কর্মজীবনের দীর্ঘ ব্যস্ততা, এপার-ওপার ছুটে চলায় দুর্বিষহ হয়ে উঠে আমাদের জীবন। এ থেকে একটু হলেও আমরা মুক্তি পাই খোদার অশেষ মেরেবানিতে। পুরো একটি বছর আমাদের জীবনে বয়ে যায় অসহনীয় যন্ত্রণা। ঈদ উপলক্ষ্যে ক’দিন থাকে মুক্তি শত ব্যস্ততা থেকে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবনে ঈদ ছাড়া তেমন কোনো টানা বিশ্রাম থাকে না, থাকে না আনন্দের আমেজ। ঈদ উপলক্ষ্যে অন্তত তিন থেকে চারদিনের বিশ্রাম নেওয়া যায়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গ্রামের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মিলন ঘটে ঈদ এলে। অনেকে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে শহুরে জীবনযাপন করেন। সহসাই তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় না। মহান আল্লাহর মেহেরবানিতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মিলন ঘটে পবিত্র ঈদ উপলক্ষ্যে। পরিবারের সবার সঙ্গে বসে খাওয়া, গল্পগুজব করে বেশ আনন্দে কাটানো যায় ঈদ এলে।

অতীতের দুঃখবেদনা ভুলে আনন্দের একটি দিন উদযাপন করতে কতই না আয়োজন করে থাকি আমরা। এই একটি দিনের জন্য আমাদের প্রতীক্ষা থাকে দীর্ঘ একটি বছর। একটি মাস সিয়াম সাধনা শেষে আমাদের তরে এসে উঁকি দেয় ঈদের চাঁদ। ত্রিশ বা উনত্রিশ দিনের এ সাধনা আমাদের জন্য আল্লাহর অশেষ মেহেরবানির। আমরা অনেকেই তা খুব সূক্ষ্মভাবে পালন করতে চেষ্টা করি। দিনের প্রখর রোদে আমাদের দেহ ক্লান্ত হয়ে যায়। ক্ষুধাযন্ত্রণায় আমরা কাতর হই। তবুও সব যন্ত্রণা দূরে ঠেলে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করতে আমরা দ্বিধা করি না। মহান সৃষ্টিকর্তার ভয়ে আমরা আমাদের জীবনের যাবতীয় চাহিদা থেকে দূরে থাকি। অবশ্যই আমরা এতে সওয়াব হাসিল করি। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভয় আমাদের জীবন পরিপূর্ণ করে। পার্থিব জীবনের যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্তি ও পরকালের শান্তি কামনায় আমরা এই একটি মাস যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করি। মহান রাব্বুলআ’লামিনের ইবাদত, তাঁর আদেশ নির্দেশ মেনে চললে আমরা কখনো পথভ্রষ্ট হব না ইনশাআল্লাহ।

আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসী, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি আমাদের মঙ্গল চান সর্বদা। তাই তাঁর প্রদত্ত মহাগ্রন্থ আলকুরআনে আমাদের জীবনের পথ সুগম করতে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া আছে। আমরা সে অনুসারে চললে নিশ্চয়ই ইহকালের সুখ ও পরকালের মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হব।

মহান রাব্বুলআ’লামিন প্রেরিত মানবতার মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পথ অনুসরণ সমস্ত মুসলিম জাতির মঙ্গল নিহিত। তাঁর দেখানো পথে যদি আমাদের জীবন পরিচালনা করি, তাহলে পরকালের প্রশান্তি আমাদের নিশ্চিত। ইহকালেও আমাদের জীবন রঙিন হবে। রমজান মাস সম্পর্কে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সে ব্যক্তি প্রকৃতই দুর্ভাগা বা হতভাগ্য, যে রমজান মাস পেয়েও মহান আল্লাহর ক্ষমা হতে বঞ্চিত হয়।’ আল্লাহ ও মহানবী (সা.)-এর হুকুম অনুযায়ী জাকাত ও ফিত্রা সঠিক নিয়মে বণ্টন করা হয়, তাহলে জগতের সব শ্রেণির লোকেরা ঈদ উদযাপন থেকে বঞ্চিত হবেন না।

আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই একটি মাস একটু বেশিই ইবাদতবন্দেগিতে ব্যস্ত থাকি। মহান সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের আশায় দিনের ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা উপবাস করি। অশেষ নেকির আশায় আমাদের ক্লান্তি দূরে ঠেলে রাতের শুরুতে বিশ রাকাআ’ত তারাবিহর নামাজ আদায় করে থাকি। রাতের মধ্যভাগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ি। আমাদের বিশ্বাস আমাদের এ ইবাদত বিফলে যাবে না। আমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হয়ে তাঁর মেহেরবানির আশায় দিনরাত ইবাদতে মত্ত থাকি। আমাদের উদ্দেশ্য পাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। সওয়াবের ঝুলি পূর্ণ করা।

যান্ত্রিক জীবনে পড়ে আমরা অনেকেই পথভ্রষ্ট হই। কিন্তু রমজানের এই একটি মাস আমাদের জীবনের যাবতীয় পাপ পরিমার্জনের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, যদি আমরা এ মাসের গুরুত্ব বুঝি ও পালন করি। এ মাস সম্পর্কে কুরআন-হাদিসে অনেক আদেশ নির্দেশ দেওয়া আছে। এ মাসের ছোট কয়েকটি ইবাদতই আমাদের জীবনের সকল গুনাহ মুছে দেয়। এ মাসের একটি নফল ইবাদত একটি ফরজ ইবাদতের সমান। একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমতুল্য।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ, যথা- ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত। মহাগ্রন্থ আলকুরআনে বার বার নামাজ ও জাকাতের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জাকাত হচ্ছে দুস্থ-অসহায় লোকদের হক। আমরা তাঁদের হক আদায় না করলে আমাদের কোনো ইবাদতেও ইহকাল ও পরকালে মুক্তি পাব না। ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে জাকাত ও ফিত্রা বিতরণ করা আমাদের কর্তব্য। আমরা যদি সঠিকভাবে জাকাত বিতরণ করি, তাহলে এ সমাজের কেউই ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন না। আমাদের নৈতিকতা বজায় রাখতে আমরা অবশ্যই গরিব-দুঃখীদের হক আদায় করার চেষ্টা করব।

শহরের আকাশচুম্বী অট্টালিকার নিচে দেখা যায় গৃহহীন নর-নারীর জীবনযাপন। তাদের ঈদ-আনন্দ বলতে কিছু নেই। তারা প্রতিনিয়তই স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। ঈদের দিনেও দেখা যায় কত দুবির্ষহ তাদের জীবন। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে নেই ঈদের আমেজ। প্রতিদিনের রোজগারে যাদের জীবন চলে, তারা কীভাবে ঈদ উদযাপন করবেন? মধ্যবিত্তদের অনেকেই সংসার চালাতে হিমশিম খান। এর মধ্যে ঘরে ঈদ উঁকি দিলে কীভাবে তা সামাল দেবেন-এ নিয়ে ভাবনায় পড়েন। আজকাল সংসার চালানো যেনতেন কথা নয়। সংসারের খরচ, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ ইত্যাদিতে মধ্যবিত্তদের জীবনে ঈদের আমেজ থাকে না।

ঈদে যাঁর যা সামর্থ্য থাকে, তা দিয়েই ঈদের আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। আমাদের শত সমস্যার মাঝেও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে মহান রাব্বুলআ’লামিন তাঁর রহমত বিলিয়ে দেন। ছিন্নমূল মানুষেরা যাতে ঈদ উদযাপন করতে পারেন, সে জন্য বিত্তশালীদের উচিত তাদের দিকে নজর দেওয়া। আমরা শুধু আমাদের পরিবারপরিজনদের নিয়ে ঈদ উদযাপন করলেই হবে না, আমাদের নৈতিক দায়িত্ব সমাজের খেটেখাওয়া মানুষদের দিকে সুনজর দেওয়া। তারা কীভাবে আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমপরিমাণভাবে ঈদের উৎসব উপভোগ করতে পারেন, তা লক্ষ্য রাখতে হবে। বিশেষ করে পথশিশুদের জন্য আমাদের এগিয়ে আসা উচিত। তাদের অনেকেই অভিভাবকহীন। মা-বাবা অনেকের থেকেও নেই। তাদের জন্য আমাদের কিছু করা অবশ্যই কর্তব্য। আমরা যদি পাড়ামহল্লায় বন্ধুবান্ধব মিলে চাঁদা তুলে তাদের জন্য কিছু করি, তা অবশ্যই সমাজে প্রশংসনীয় এবং মহানআল্লাহও তাতে খুশি হবেন।

তাছাড়া অন্যরাও তাতে উৎসাহিত হবেন। বিশেষ করে আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী অনেকে আছেন, যাঁদের সামর্থ্য নেই ঈদ উদযাপনের, অথচ প্রতিবেশী অনেককে দেখা যায় চড়া মূলে ঈদের পোশাক কিনে আনছেন। আমরা যদি আমাদের প্রতিবেশীদের দিকে একটু নজর না দিই, তাহলে আমাদের জীবনের যাবতীয় ইবাদত বৃথা যাবে। আমাদের উচিত, যার যতটুকু সামর্থ্য হয়, তা দিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া।

ঈদ আমাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুলআ’লামিন প্রদত্ত বিরাট নিয়ামতের দিন। কিন্তু আমরা তা আমোদ-ফুর্তি করে কাটাই। আমাদের বুঝা উচিত মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় ঈদেও। শুধু রমজানেই না, ঈদেও তাঁর অসীম রহমত বর্ষিত হয়। আমার অনেকেই তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই আমোদে পড়ে। আমরা যেন ঈদকে পশ্চিমাদের আনন্দের মতো উদযাপন না করি, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। বিশেষ করে উঠতি যুবকদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা প্রকাশ পায়, যাতে সমাজের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে। অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের জীবনকে কীভাবে সুশৃঙ্খল করা যায়, সেদিকে নজর দেয়া। আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাদের জীবনপদ্ধতিতে অনেক অবনতি হয়েছে। যা একটি সভ্য সমাজে কাম্য নয়। সৃষ্টিকর্তার মহিমান্বিত ঈদের আনন্দে যেন আমাদের জীবনের যাবতীয় দুঃখদুর্দশা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই, সে জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে যথাযথভাবে ঈদ উদযাপনের তৌফিক দান করুন। আমিন।

(এটিআর/জুলাই ২৫, ২০১৪)