মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : পটুয়াখালীর কুয়াকাটার তুলাতলী ২০ শয্যা হাসপাতাল থেকে খাজুরা গ্রামের দুরত্ব প্রায় ১০ কিমিঃ। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন  জেলে অধ্যুষিত এ গ্রামের মানুষকে আধুনিক চিকিৎসার যুগেও চিকিৎসা ও সন্তান প্রসবের জন্য ঝাড়-ফুঁকের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। গ্রাম্য দাইয়ের অদক্ষতায় গৃহবধুরা সুস্থ্য সন্তান প্রসব করলেও সঠিক চিকিৎসা ও কুসংস্কারের কারনে সদ্যজাত শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। রোগব্যাধী হলে তাদের গলায় ঝোলানো হচ্ছে একেরপরএক মাদুলী। এমন কথাই জানালেন দুই সন্তান হারানো তাছলিমা বেগমসহ অনেকে। 

২০০৭ সালের সিডরে সর্বস্ব হারানো পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটা সৈকত ঘেষা আদর্শ গ্রামের ৬০ টি পরিবার মাথা গোঁজার ঠাই পায় খাজুরার ব্রিটিশ রেড ক্রিসেন্ট পল্লীতে। এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। মাথা গোঁজার আশ্রয় পেলেও নেই পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা। গ্রাম থেকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে স্কুল হওয়ায় প্রাথমিকের গন্ডি না পেরোতেই শিশু বিয়ের ঘটনা এখানে নিয়মিত। অল্প বয়সে মা হওয়ায় ও পারিবারিক অস্বচ্ছলতায় ৬০ পরিবার নিয়ে গড়ে ওঠা এ পল্লীতে স্বামী পরিত্যক্তা ও ডিভোর্সী নারীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামীর কারনে পৌর শহরের বাসিন্দা হলেও তারা রয়েছে অবহেলিত। কুসংস্কারে ঘেরা এ গ্রামের মানুষ সামান্য জ্বর,সর্দি কিংবা যেকোন অসুখে ওজা ও দাইয়ের স্বরনাপন্ন হচ্ছে।

ভূক্তভোগী একাধিক গৃহবধু বলেন, তাদের সুস্থ্য সন্তান প্রসব হলেও সন্তান প্রসবের কয়েক ঘন্টার মধ্যে সঠিক চিকিৎসার অভাবে শিশু মারা যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা এ মৃত্যুকে ভূত-প্রেতের আছর হিসেবে উল্লেখ করে স্বাভাবিক হিসেবে দেখলেও সন্তান হারিয়ে অনেক মা এখন পাগল প্রায়।

তাদেরই একজন তাছলিমা বেগম। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে গ্রাম্য দাইয়ের সহায়তায় তিনি ফুটফুটে জমজ দুই সন্তান প্রসব করেন। কিন্তু সন্তান প্রসবের পাঁচ ঘন্টার মধ্যে রাত দুইটার দিকে হঠাৎ ছেলে সন্তানটি অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। তখন তাকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে ওই রাতে হাজির করা হয় এক ওজাকে। যে ওজা সন্তান গর্ভাবস্থায়ও তাকে দেখেছিলেন। তিনি কয়েক ঘন্টা ফু-ফা দিয়ে চেষ্টা করে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি।

সন্তান মৃত্যুর পরদিন সকালে যখন শিশুকে দাফনের প্রমÍুতি নিচ্ছে গ্রামবাসীরা। ঠিক সেই মুহুর্তে আবার অসুস্থ্য হয়ে পড়ে মেয়ে শিশুটিও। তখনও আনা হয় ওজাকে। কিন্তু মেয়েটিও মারা যায়।

তিনি বলেন, যদি ওজার কাছে না নিয়ে তার দুই সন্তানকে ডাক্তারের কাছে নেয়া হতো তাহলে হয়তো দুই সন্তানই বেঁচে থাকতো।

একাধিক গ্রামবাসীরা বলেন, আর্থিক সংকট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দূরাবস্থার কারনে অনেক পরিবার ইচ্ছে থাকা সত্বেও কেউ অসুস্থ্য হলে ডাক্তারের কাছে যেতে পারছে না। এ কারনে ওজাই তাদের ভরসা। গ্রামবাসীদের দাবি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও এলাকায় একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মান করা হোক। তাহলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে গ্রামের মানুষ।

কুয়াকাটা পৌর মেয়র আঃ বারেক মোল্লা বলেন, এখানে হাসপাতাল আছে ঠিকই কিন্তু নেই চিকিৎসক। হাসপাতাল নির্মান হওয়ার প্রথম ছয় মাস তুলাতলী হাসপাতালে ডাক্তার থাকলেও এখন ডাক্তার এসেই চলে যায়। এ কারনে জরুরী প্রয়োজনে মানুষ হাসপাতালে যেতে চায়না। তাই বাধ্য হচ্ছে গ্রাম্য ওজা ও দাইয়ের চিকিৎসা নিতে।

তুলাতলী হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার ডা. আরিফুর রহমান বলেন, হাসপাতালের জনবল ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সংকট রয়েছে। তিনিই এখানে একমাত্র চিকিৎসক। এখানে সব সুবিধা না থাকায় তাদের ইচ্ছে থাকা সত্বেও সব রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারছেন না।

(এমকে/এসপি/এপ্রিল ১৭, ২০১৯)