নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁ সদর উপজেলার দুবলহাটী ইউনিয়নের সরিষপুর গ্রামের হাজী পাড়ায় ৯ বছরের শিশু কবিরাজি দিপুর দেয়া পানি পড়া খেয়ে নিঃসন্তান গৃহবধূ অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন। এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে একটি সন্তানের আশায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে শত শত দম্পতিরা ছুটে আসছেন সেই শিশুর কাছে পানি পড়া নিতে। এমন অদ্ভুত খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা জেরা জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এমন গুজব ছড়িয়ে স্থানীয় একশ্রেনীর প্রতারক এসব মানুষের কাছে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া শুরু করে। খবরটি পৌঁছে যায় সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আব্দুল হাই নিউটনের কানে। তিনি সেখানে প্রথমে সাদা পোষাকে পুলিশ পাঠিয়ে এবিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ওই শিশু কবিরাজ ও তার সঙ্গীদের থানায় তুলে নিয়ে আসেন।

কবিরাজ! মাত্র ৯ বছরের শিশু হওয়ায় ‘ভবিষ্যতে সে এমন অপকর্ম করবে না মর্মে ’ মুচলেকা লিখে দিয়ে মুক্তি পায়। বর্তমানে সেখানে পানিপড়া দেয়ার সকল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে ওসি নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে সরিষপুর গ্রাম। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামে প্রবেশ পথে রাস্তার দু’ধারে মাইক্রোবাস, অটোচার্জার ও ভ্যান গাড়ি সারি সারি করে রাখা আছে। রাস্তা থেকে দিপু কবিরাজের বাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার দুরে। রাস্তা থেকে কবিরাজের বাড়ি পর্যন্ত মানুষ লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া-আসা করছেন। হাজী পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, একটি আম বাগানের মধ্যে টিনের বেড়া দিয়ে তৈরী একটি ঘর ও বারান্দা। আর এ বারান্দায় বসে পানি পড়া দিচ্ছে শিশু কবিরাজ দিপু। কবিরাজের সামনে একটি দান বাক্স মসজিদের জন্য এবং ঘরের বাহিরে আরেকটি দানবাক্স মন্দিরের জন্য রাখা আছে। যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা বাক্সে নিজেদের ইচ্ছেমত দান করছেন।

আর এ ঘরের আশপাশে অন্তত দেড় হাজার মহিলা প্রত্যেকের হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাগের মধ্যে আছে একটি করে পানির বোতল। মহিলাদের সাথে এসেছেন আত্মীয়স্বজন ও স্বামী। আর আম বাগানের মধ্যেই মাদুর পেতে অনেকে শুয়ে-বসে আছেন। আবার অনেকেই রান্নার জন্য খাসি, মুরগি জবাই করছেন। আবার অনেকে সেই রান্না জোগান দিতে পিয়াজ-রসুন বাছাই করছেন। এযেন কোন মাজারে বা দরগায় মানত দেয়ার মত অবস্থা।

দিপু কবিরাজের কাছে পানি পড়া নেবার জন্য রাত থেকে এ হাজী পাড়ার আম বাগানে অনেকে অবস্থান নিয়েছেন। তার বাড়ির দরজা থেকে শুরু হয়েছে লাইন। ফজরের নামাজ পর শুরু হয় পানি পড়া দেয়া। আর এ দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক মহিলা ক্লান্ত হয়ে লাইনের পাশে বসে পড়েন। কবিরাজের দরজায় আলম নামে এক যুবক পাহারা দিচ্ছে। মহিলারা একে একে কবিরাজের কাছে যাচ্ছেন আর ২/৩ মিনিট পর পানি পড়া নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। আলমের মতো এখানে ১৫/২০ জন যুবক বাহির থেকে আসা মানুষদের নিয়ন্ত্রন করছেন। আর পানি পড়া দিতে গিয়ে কিছু সময় পর পর তার আসন ছেড়ে বাহিরে গিয়ে খেলাধুলা ও দোকান থেকে জিনিস কিনে খেতে দেখা গেছে দিপুকে।

জানা গেছে, দুই সন্তান নিয়ে অন্যের জমিতে টিনের কুঠির ঘর তৈরি করে বসবাস করে আছেন দিপুর মা দেলেয়ারা বেগম। স্বামী তাদের ছেড়ে অনেক আগে চলে গেছেন। বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন আর কাজ করতে হয় না। গ্রামের সমসের আলী হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে কবিরাজ দিপু। তবে কুরআন পড়া এখনো শুরু হয়নি। দিপুর বয়স ৯ বছর হলেও ৬ বছর বয়স থেকে পানি পড়া দিয়ে আসছে।

প্রতিবেশী জহুরুল ইসলামের বউয়ের দীর্ঘদিন থেকে কোন বাচ্চা হয়নি। তিন বছর আগে তার বউকে পানি পড়া দেয়া হলে গর্ভধারন করে এবং বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবারও একটি মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়। গত তিন বছর থেকে এ কবিরাজি চিকিৎসা দিয়ে আসছে। তখন তেমন ভিড় ছিলনা। এ বিষয়ে তেমন কোন প্রচার-প্রচারনা করা হয়নি। যাদের বাচ্চা হয়েছে এবং উপকৃত হয়েছেন তারাই মূলত এ প্রচার প্রচারনা করেছেন।

তবে গত তিনমাস থেকে কবিরাজ দিপুর কাছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া ও জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত নারী-পুরুষ আসছেন পানি পড়া নিতে। পড়া পানি একজন নারী দিনে দু’ার খেতে হয় এবং একজন পুরুষ পড়া মধু দিনে দুবার খেতে হয়। এছাড়া পড়া তেল একজন পুরুষ দিন দুবার শরীরে মাখতে হয়। একজন নারীকে ৩/৫ সপ্তাহ চিকিৎসা নিতে হয়। এরমধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়। অন্তঃসত্ত্বা হলে ডাক্তার দিয়ে কোন চিকিৎসা বা আল্ট্রাসোনো করানো যাবে না বলেও নিষেধ করা হয়। প্রতি শুক্রবার করে পানি পড়া দেয়া হয়ে থাকে। কবিরাজি চিকিৎসা নিতে খরচ হয় তাবিজ ১৩০ টাকা এবং কবিরাজি ফি ১০ টাকা। যাদের মনোবাসনা পূরন হয় তারা কবিরাজের বাড়িতে এসে খাসি জবাই করে উপস্থিত সবার মাঝে বিতরণ করেন। গত শুক্রবার ২৮টি খাসি জবাই করা হয়েছে বলেও জানা যায়।

নওগাঁ সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের গত ২৩ বছরে তাদের দাম্পত্য জীবনে কোন সন্তান নাই। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কবিরাজের বাড়িতে এসে স্ত্রী শাহিদা বেগম লাইনে দাঁড়ান। তিনি বলেন, বিভিন্ন ডাক্তার ও কবিরাজের কাছে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চিকিৎসা নিয়েও কোন কাজ হয়নি। কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সংবাদ পেয়ে এখানে এসেছি পানি পড়া নিতে। শুক্রবার বেলা ১০ টা পর্যন্ত তার স্ত্রী সামনে আরো ৩০ জন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল।

রাজশাহীর পুটিয়া থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুল শিক্ষিকা বলেন, বৃহস্পতিবার তার মাকে কবিরাজের বাড়িতে পাঠিছেন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তিনি কবিরাজের বাড়িতে এসে প্রায় দেড়শ জনের পিছনে জায়গা পেয়েছেনে। দাম্পত্য জীবনে গত ১০ বছর হলো কোন সন্তান নেই। পানি পড়ার বিষয়টি জানতে পেরে মনের বিশ্বাস নিয়ে এসেছেন।

দুবলহাটী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান বলেন, মানুষ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তা জানি না। তবে এটা ভূয়া ও মানুষের সাথে প্রতারনা। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুরদুরান্ত থেকে লোকজন আসছে। এটা নিয়ে এলাকায় একটা পক্ষ (গ্রুপিং) তৈরী হয়েছে। যে কোন সময় সংঘর্ষের সৃষ্টি হতে পারে। প্রশাসনকে এ বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।

নওগাঁ সিভিল সার্জন ডাঃ মুমিনুল হক বলেন, মেডিক্যাল সাইন্সে বন্ধা কোন নারী পানি পড়া খেয়ে পেটে বাচ্চা আসে এরকম কোন নিয়ম নাই। এছাড়া সাইনটিফিকে (বৈজ্ঞানিক) এরকম কোন বিধানও নেই। যেখানে পানি, মধু পড়া এবং তেল পড়া ব্যবহার করলে পেটে বাচ্চা আসে।

সোমবার নওগাঁ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল হাই নিউটন বলেন, ছদ্মবেশে ঘটনাস্থলে (বৃহস্পতিবার) পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ওই ভন্ড কবিরাজ দিপু ও তার সঙ্গীদের থানায় ধরে আনা হয়েছিল। বয়স কম হওয়ায় তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

(বিএম/এসপি/এপ্রিল ২৯, ২০১৯)