রূপক মুখার্জি : তানিয়া, তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়। লজ্জ্বায় মাথা নত হয়ে পড়ে। ভয়, আতংক আর চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তানিয়াদের জীবনযাপন। কোথাও সুরক্ষা নেই তাদের। সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনে দৃশ্যতঃ ব্যর্থ। প্রশ্ন উঠেছে, এমনি করেই কি তানিয়ারা চলে যাবে ? এক একজন তানিয়ার হৃদয় বিদারক প্রস্থানে আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই ? রাষ্ট্র কি ঠুঠো জগন্নাথ হয়ে গেছে। মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে সকলেরই প্রশ্ন, এ সব পৈশাচিক ও বর্বরতার শেষ কোথায় ? এ সব প্রশ্ন সরাসরি, তাতে কোন রাখঢাক নেই।

চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা, যৌন হেনস্তা, যৌন নিপীড়ন নতুন কোন ঘটনা নয়। এ সব বর্বর, পৈশাচিক ঘটনা ‘স্বাভাবিক’ ঘটনায় রুপ নিচ্ছে কি ? বিষয়টি দ্রুত ভেবে দেখার পাশাপাশি তরিৎ ব্যবস্থা গ্রহনের সময়ই এখন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে একটি বহুজাতিক কোম্পানীর কর্মী রুপা খাতুনকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে হয়। আর পৈশাচিক কাজে জড়িত ছিল ছোয়া নাম গণপরিবহনের শ্রমিকরা। তারা রুপাকে ধর্ষণ শেষে ঘাড় মটকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় আদালত ওই বাসের চালক, সহকারি সহ চার জনের মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে।

রুপার ঘটনার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট টাঙ্গাইলে আবারো চলন্ত বাসে এক প্রতিবন্ধী কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়। একই বছরের ৮ এপ্রিল ঢাকার ধামরাইয়ে চলন্ত বাসে এক নারী পোশাক শ্রমিক ধর্ষণের শিকার হয়। এর আগে ২০১৬ সালে ২৩ জানুয়ারি বরিশালে চলন্ত বাসে শিকার হয় দুই নারী। এরও আগে ২০১৩ সালে ২৪ জানুয়ারি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ এলাকায় এক নারী পোশাক শ্রমিক ধর্ষিত হয়। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে রাজধানী ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, সাভার, চট্টগ্রাম সহ দেশের অন্যান্য স্থানে চলন্ত বাসে ধর্ষণ চেষ্টা ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

উল্লেখিত পরিসংখ্যানই বলছে, চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা নতুন কোন অপরাধ নয়। মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হচ্ছে। আজকের পরিবর্তিত সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন দৃশ্যমান, তখন চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণ, হেনস্তা ও যৌন নিপীড়নকে কোনক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না। সমাজ, রাষ্ট্র এবং সরকার এ ধরনের ঘটনা রোধে সময় উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এমন প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের। জনপ্রত্যাশা পূরনে সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকার আরও উদ্যোগী হবেন-সাধারণ মানুষের এমন ভাবনা থাকতেই পারে।

শাহিনুর আক্তার তানিয়া। পেশায় একজন নার্স। সেবার ব্রত নিয়ে তানিয়া ঢাকার ইবনেসিনা হাসপাতালে যোগদান করে। অসহায় ও দুস্থ্য মানুষের সেবায় ব্রতী হওয়ার আগেই ধর্ষক দলের নির্মম শিকারে পরিণত হয়ে তানিয়াও চলে গেল না ফেরার দেশে। কিশোরগঞ্জে কটিয়াদি উপজেলার লোহাজুড়ি ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে নিহত শাহিনুর আক্তার তানিয়া।

দরিদ্র ও কৃষিজীবি পরিবারের সন্তান তানিয়া । তার বাবা গিয়াস উদ্দিন পেশায় একজন বর্গা চাষি। গ্রামের মানুষজনদের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়ে আসছেন তিনি। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তানিয়া সবার ছোট। কটিয়াদির স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাশ করে তানিয়া ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ নার্সিং ইনষ্টিটিউটে। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কোর্স শেষ করে আট মাস আগে ঢাকার ইবনেসিনা হাসপাতালে নার্সের চাকুরিতে যোগদান করে তানিয়া। ঢাকার কল্যাণপুর এলাকায় একটি মেসে থেকে চাকুরী করতো তানিয়া। চাকুরী পাওয়ার দু’মাসের মাথায় তার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অবিবাহিত হওয়ায় তানিয়া চাকুরীর বেতনের পুরোটাই বাড়ি পাঠিয়ে দিত। আর তা দিয়েই ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ চলতো।

প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের রাজধানী দিল্লীতে চলন্ত বাসে জ্যোতি সিংহ পা-ে নামে একজন মেডিকেল কলেজ ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যান। এ নিয়ে দিল্লী সহ ভারত জুড়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। সরকারও নড়েচড়ে বসে। গ্রেপ্তার হয় ধর্ষক দল। পরে এ ঘটনায় চার জনের মৃতুদ- প্রদান করে দিল্লীর হাইকোর্ট।

চলন্ত বাসে যৌন হেনস্তা, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ প্রচেষ্টা, ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে সমাজ, রাষ্ট্র তথা সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। বর্বর, পাশবিক, পৈশাচিক ঘটনারোধে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না, অপরাধীকে সাজা পেতে হবে-এমন ব্যবস্থা কার্যকর করার মাধ্যমেই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। প্রতিবাদেই শাস্তি হয় অপরাধীর। প্রতিরোধে ভয় পায় অপরাধী। অপরাধ এবং অপরাধী দমনে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সচেতন মানুষ এগিয়ে আসবে, জাগ্রত হবে, সোচ্চার হবে-এমন প্রত্যাশা যেন নিরাশায় পরিণত না হয়।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী, নড়াইল।