মাদারীপুর প্রতিনিধি : দালালদের খপ্পরে জিম্মি হয়ে সাগর পথে লিবিয়া থেকে ইটালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ট্রলার ডুবির ঘটনায় মাদারীপুর শিবচরের নিহত জাকির হোসেন (২৮) ও মাদারীপুর সদর উপজেলার সজীব হোসেন শিকদারের (১৮) পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তারা কিছুতেই এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেনা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত জাকির হোসেন শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের ৮নং চর গ্রামের সেকান্দার হাওলাদারের ছেলে এবং সজিব শিকদার সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের উত্তর শিরখাড়া গ্রামের আদেলউদ্দিন শিকদারের ছেলে।

এছাড়াও এই ঘটনায় নিখোঁজ আছে মাদারীপুর সদর উপজেলার মনির হোসেন মাতুব্বর (২২), নাদিম মাতুব্বর (১৭), সাইফুল ইসলাম (২৪) ও রাজৈর উপজেলার নাঈম সিকদার (১৯) নামের ৪ যুবক।

স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে অর্থ উপার্জনের জন্য নূর-নবী খলিফা ও নূর ইসলাম খলিফা নামের দুই দালালের হাত ধরে বিদেশে পারি জমায় শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের ৮নং চর গ্রামের সেকান্দার হাওলাদারের ছেলে জাকির হোসেন। জাকিরকে স্থলপথে তুরস্ক নেওয়ার কথা থাকলেও দালাল চক্র লিবিয়া নিয়ে জিম্মি করে। লিবিয়ায় জাকির হোসেনকে আটকে রেখে পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন সময় টাকা দাবী করে তারা। টাকা দিতে অস্বীকার করলেই ছেলেকে বিক্রি করে দিবে অথবা অনাহারে রাখবে বলে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে। এ পর্যন্ত পরিবার প্রায় ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা দালালচক্রের কাছে দেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার ভূমধ্যসাগরে লিবিয়ার উপকুল থেকে ৭৫ জন অভিবাসী নিয়ে ইটালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া ট্রলার ডুবিতে নিহত হন এই জাকির হোসেন।

জাকির হোসেনকে হারিয়ে এখন দিশেহারা স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের লোকজন। স্বামীকে হারিয়ে কান্না যেন থামছেই না স্ত্রী শান্তা আক্তারের। অবুঝ দুটি কন্যা সন্তানকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই পরিবারের লোকজনের। সন্তান ট্রলার ডুবিতে নিহত হওয়াকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছেনা নিহত জাকিরের বাবা-মাসহ স্বজনরা।

এদিকে মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের উত্তর শিরখাড়া গ্রামের সজীব হোসেন শিকদার নৌকাডুবিতে মারা গেছেন। তার পিতার নাম আদেলউদ্দিন শিকদার। মা বেবী খাতুন। এক বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সজীব সবার ছোট। পরিবারের সদস্যরা নিহতের সংবাদটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।

সজীবের মা বেবী খাতুন কোনভাবেই ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেনা। তার বিশ্বাস ছেলে বেচে আছে। তাই সে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে আমার সন্তানকে ভিক্ষা চাই। আমার মনে হয় আমার ছেলে বেঁচে আছে। ও আমাদের কাছে ফিরে আসবে। আল্লাহ, আমার সজীবকে আমার কাছে ফিরাইয়া দাও।
সজিবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির চারপাশে মানুষের ভিড়। সজিবের মা ও বোন যেন একটু পর পরেই সজিবের ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছেন।

সজিবের স্বজনরা জানান, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না দিয়েই গত ঈদের পরের দিন এক দালালের হাত ধরে লিবিয়া যায় সজিব। এরপর লিবিয়াতে ছয় মাস কাজ করার পরে নোয়াখালীর রুমান নামে এক দালালের খপ্পরে পরে সজিব। সেই দালাল আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে সজিবকে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। সজিব রাজি হয় তার সাথে যেতে। এরপর দালাল টাকা আটকে রেখে সজিবকে লিবিয়ার জিম্মি দশায় বন্দি করে রাখে। এরপর দীর্ঘ চার মাস পরে গত বৃহস্পতিবার সজিবকে অবৈধ পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়া পৌছানোর কথা বলে সজিবকে নৌকায় তোলা হয়।
সজিবের বোন মিম আক্তার বলেন, ‘আমারে আফা কইয়া আর কে বোলাইবো (ডাকবে)। আমার ভাইরে এক বছর রাইখা কেন বৃহস্পতিবার পাঠাইলি। আমি এহন কেমনে ভাইরে ভুইলা থাকমুরে। কোথায় গেলি সজিব।

এছাড়া ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়েনের পশ্চিম বল্লভদী গ্রামের আদারী মাতুব্বরের ছেলে মনির হোসেন নামের একজন নিখোঁজ আছে। গত বছরের রমজান মাসে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মনির চতুর্থ। নৌকাডুবির আগে গত ৯ মে সে যোগাযোগ করেছিল বলে জানান পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত মনির ওই নৌকায় ছিলেন। তাদের বিশ্বাস মনির এখনও বেঁচে আছেন।

একই ইউনিয়নের শ্রীনদী গ্রামের জুবায়ের মাতুব্বরের ছেলে নাদিম মাতুব্বর নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হন। সে এক বছর আগে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে লিবিয়া গিয়েছিলেন। সাত লাখ টাকা খরচ করে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে সে ইতালির উদ্দেশে পাড়ি জমান।

মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর মঠেরবাজার এলাকার মজিবর রহমানের ছেলে সাইফুল ইসলাম ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে।

এছাড়া মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আলম দস্তার গ্রামের জাফর সিকদারের ছেলে নাইম সিকদার নিখোঁজ রয়েছেন।
এই ঘটনায় নিহতদের লাশ দেশে আনার পাশাপাশি নিখোঁজদের ফিরে পেতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন স্বজনরা। এছাড়াও দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।

মাদারীপুর শিরখাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত শিরখাড়া ইউনিয়নের একজন নিহত ও দুইজন নিখোঁজের তথ্য পেয়েছি। আমরা ওই যুবকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সব ধরণের সহায়তা করা হবে।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি মাদারীপুর শাখার যুব প্রধান শিশির হোসেন বলেন, ‘‘তিউনিসিয়ার উপকূলের কাছে নৌকা ডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত মাদারীপুরের কয়েকজনের নাম জানা গেছে। এরমধ্যে সজীব নামে একজনের নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমরা নিহত ও নিখোঁজদের বাড়িতে গিয়ে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করছি।’

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, ভূমধ্যসাগরে নিহত ও নিখোঁজদের বিষয়ে জেলা প্রশাসন খোঁজ রাখছে। পরিবারগুলোকে এ বিষয়ে সব ধরণের সহযোগিতা করা হবে।

(এ/এসপি/মে ১৫, ২০১৯)