শরীয়তপুর প্রতিনিধি : ছয় ফিটেরও অধিক লম্বা ছিল দরিদ্র মৎসজীবী বাবার ছেলে উত্তম দাস। শত প্রতিকুলতাকে পেছনে ফেলে ছেলেকে লেখা-পড়া করিয়েছেন বাবা-মা। নড়িয়া সরকারি কলেজের স্নাতকের ছাত্র ছিল উত্তম। পরিবারের নিষেধ উপেক্ষা করে ৯ মাস আগে দালালের খপ্পরে পরে লিবিয়া পাড়ি জমায় সে। স্বপ্ন ছিল ইতালী যাবে। মা-বাবার কষ্টের দিন ঘোচাবে। কই, সে আশা বুঝি এখন শুধুই হতাশায় ঢেকে গেল। উত্তমের মা কবিতা রানী দাস সারাক্ষন পুত্রের ছবি বুকে নিয়ে বিলাপ করছে, আর বলছেন- বুকে ফিরে আয় বাবা আমার। শুধু উত্তম দাসের পরিবারেই না, এমনি শরীয়তপুরের আরো ৫টি পরিবারে গত ৫ দিন থেকে চলছে সন্তান নিখোঁজের ঘটনায় আহাজারি।

গত শুক্রবার অবৈধভাবে লিভিয়া থেকে নৌকাযোগে শতাধিক অভিবাসী যাত্রী নিয়ে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে গভীর রাতে নিউনিয়াশিয়া উপকুলে নৌকাটি ডুবে যায়। যাত্রীদের মধ্যে অন্তত ৭৮ ব্যক্তির মৃত্যুর খবর প্রকাশ পায়। যার মধ্যে ৩৭ জন বাংলাদেশী। ওই নৌকায় শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ৭/৮ যুবক ছিল বলে জানা গেছে। তাদের অন্তত ৬ যুবক এখনো নিখোঁজ থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ওই নৌকায় থাকা একই এলাকার দুই যুবক তিউনিশিয়ার একটি আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন বলেও জানা গেছে পারিবারিক সূত্রে।

এখনো যারা নিখোঁজ রয়েছে তারা হলো নড়িয়া উপজেলার ভূমখাড়া ইউনিয়নের পাটদল গ্রামের মৃত হাসেম মোল্যার ছেলে সুমন মোল্যা (২৪), দক্ষিণ চাকধ গ্রামের গৌতম দাসের ছেলে উত্তম দাস (২৩), হারুন হাওলাদারের ছেলে জুম্মান হাওলাদার (১৯) চাকধ গ্রামের মোর্শেদ আলী মৃধার ছেলে পারভেজ মৃধা (২২), নয়াকান্দি গ্রামের রাজিব ও রনি। ওই ট্রলারে থাকা দক্ষিণ চাকধ গ্রামের আলাউদ্দিন মকদমের ছেলে শিশির মকদম (২২) ও শিশিরের মামা নলতা গ্রামের মিন্টু মিয়া (৩০) তিউনিসিয়ার একটি আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন। যুবকরা একই সাথে ইতালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত ৯ মাস থেকে দেড় বছরের মধ্যে তারা সবাই দালালের মাধ্যমে সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করে লিভিয়া গিয়েছিল।

নিখোঁজ জুম্মনের মা জহুরা বেগম জানান, ২০১৮ সালের রমজানের ২০ তারিখে দালালের মাধ্যমে জুম্মন লিভিয়া যায়। আমাদের আত্মীয় আক্কাস দালাল লিভিয়া পৌছে দেয়ার শর্তে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেয়। সেখানে জুম্মনকে একটি জুঁস কোম্পানীতে চাকুরী দেয়। তিনি জানান, জুম্মনের বাবা একজন দনি মজুর। বাবার কষ্ট দুর করার জন্য এনজিও থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ও ৪ লাখ টাকায় বসত বাড়ি বিক্রি করে জুম্মনকে বিদেশ পাঠাই। অলিল নামে মাদারীপুরের আরেক দালাল ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিয়ে আমার ছেলেকে ট্রলারে উঠায়। অলিল দালাল আমাদের বলেছে, মায়ের কোলে যেমন থাকে তেমনভাবে বড় ট্রলারে করে পৌছে দিব। জহুরা আরো বলেন, গত বুধবার জুম্মন আমার সাথে শেষ কথা বলে। তখন জুম্মন জানায়, আজ রাতে দালাল আমাদের ট্রলারে তুলে দিবে। ৪/৫ দিন তোমাদের সাথে আর কোন কথা হবেনা। আমার জন্য দোয়া করবা।

নিখোঁজ সুমনের বড় বোন রাহিমা আক্তার বলেন, আমাদের মা বাবা নেই। সুমন আমার ছোট ভাই। সুমন মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখার পর আর পড়েনি। পরে একটি চায়ের দোকানে কর্মচারি ছিল। গত ৯ দিন আগে সোমবার সুমনরে সাথে মোবাইল ফোনে শেষ কথা হয়। এখনো জানিনা আমার ভাই বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে।

নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে এখন চরম উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের সকলের দাবী, জীবীত হোক মৃত হোক সরকার যেন আমাদের সন্তানদের দেশে আনার ব্যবস্থা করেন।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কজী আবু তাহের বলেন, ভুমধ্যসাগরে নৌকা ডুবির ঘটনায় অনেক বাংলাদেশী যুবকের নিহতের কথা শুনেছি। তবে শরীয়তপুরের কেউ নিহত বা নিখোঁজ রয়েছেন কিনা এ বিষয়ে সরকারি কোন তথ্য আমার কাছে নেই।

(কেএন/এসপি/মে ১৫, ২০১৯)