প্রবীর সিকদার


 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধী হায়েনারা বাবা ও দাদুকে ধরে নিয়ে যায়; আর তাদের লাশও পাইনি! দুই কাকা ও এক মামাসহ আমার অন্যান্য স্বজনদের রামদা দিয়ে কুপিয়ে, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে-খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে ওরা আমার চোখের সামনেই! বাবাকে বাবা ডাকতে পারিনি এই বাংলাদেশটির জন্য!

মুক্তিযুদ্ধে বাবাসহ সর্বস্ব হারিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিবকেই পিতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করি। একাত্তরে নিখোঁজ পিতার প্রথম মৃত্যু সংবাদ পাই আমি ১৯৭৫সালের ১৫ আগস্ট! আজও আমি যখন অসহায় বোধ করি, ঘরেই পিতা মুজিবের ছবির দিকে তাকিয়ে সাহস প্রার্থনা করি। কখনো কখনো ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরে গিয়ে পিতা মুজিবের অস্তিত্ব অনুভব করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাকেই বড় বোন জ্ঞানে শ্রদ্ধা করি, আপনার মধ্যেই খুঁজে ফিরি পিতা মুজিবের অস্তিত্ব।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়বার প্রত্যয় নিয়ে এক সময় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে লেখালেখি করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের ভাড়াটে দুর্বৃত্তরা খুন করবার উদ্দেশ্যে ২০০১সালের ২০ এপ্রিল আমার ওপর নৃশংস বোমা গুলী চাপাতি হামলা চালিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার আন্তরিকতা, সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় আমি দেশে বিদেশে উন্নত চিকিৎসায় সেই যাত্রায় জীবন ফিরে পেলেও আমাকে হারাতে হয়েছে একটি পা; স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছে আমার একটি হাত। আমি শরীরে বয়ে বেড়াই অসংখ্য বোমা-গুলীর ছোট ছোট টুকরো, যা আমাকে প্রতি মুহূর্তে ভোগায়; এ যন্ত্রণা আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু!

আমার লক্ষ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি সুখি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যে আমি বিভিন্ন জেলা উপজেলায় গিয়ে তরুণদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বলি আপনার কথাও; পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে মিনি পাকিস্তানের খোলস বন্দী বাংলাদেশকে আপনি কী নিরলস ও ঝুঁকি পূর্ণ প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে রূপান্তর ঘটাচ্ছেন! আমি অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলি, কথা বলি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধেও। আর এমন কথা বলবার অনুপ্রেরণা ও শক্তি তো আপনি আমাকে জোগান দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! কেননা আপনিই বলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা! রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সম্পর্কে আপনিই আপনার সহযোগীদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেন কঠিন সত্য, 'সবাইকে কেনা যায়, কিন্তু শেখ হাসিনাকে কেনা যায় না'। অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা কিংবা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কথা বলা যদি অপরাধ হয়, তবে সেই অপরাধের শাস্তি আমার আগে আপনাকেই ভোগ করতে হবে; কেননা সেই অপরাধ করবার শক্তি ও অনুপ্রেরণা আমি আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি!

আমি বিশ্বাস করি, ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন আওয়ামীলীগে হাইব্রিড অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের যে সড়ক-মহাসড়ক বানানো হয়েছে সেটা আপনি আপনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্ট সূত্রেই অবগত। আর সেটা অবগত বলেই, ২০১৫সালের ১৬আগস্টে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ধারায় ধারার মামলায় আমি গ্রেফতার হলে আপনি গর্জে উঠেছিলেন; যার ফলে আমাকে দুই রাতের বেশি জেলখানায় আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। যদিও সেই হয়রানির মামলা এখনো বহমান। সেই সাথে বহমান সেই মামলা সংশ্লিষ্ট লুটেরা হাইব্রিড দুর্বৃত্ত চক্র ও তাদের পৃষ্ঠপোষকের হম্বিতম্বি! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অপরাধ যদি আমার হয়, শাস্তি তো আমার প্রাপ্য! সেই শাস্তি কেন ভোগ করবে আমার ভাই বোন আত্মীয়স্বজন?

গত ৮মে ছিল কানাইপুর গণহত্যা দিবসের ৪৮তম বার্ষিকী। একাত্তরের এইদিনে স্বাধীনতা বিরোধী সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা কানাইপুরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। ওই দিবস উপলক্ষে কানাইপুরে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। আমিও সেইসব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকি। এবারের অনুষ্ঠানে আমি যাইনি, ঢাকা থেকে গিয়েছিল আমার স্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সন্তান অনিতা সিকদার ও আমার কলেজ পড়ুয়া ছেলে পুলক সিকদার। কিন্তু ফরিদপুরের লুটেরা দুর্বৃত্ত চক্রের কাছে খবর ছিল, আমিও কানাইপুরে আছি। কানাইপুরে গেলে আমি আমার ভাই সুবীর সিকদারের বাড়িতেই থাকি। ওইদিন রাতেই ফরিদপুরের লুটেরা চক্রের পোষা হেলমেট বাহিনীর ২৫/৩০জন সশস্ত্র দুর্বৃত্ত আমাকে খুন করবার উদ্দেশ্যে আমার ভাই সুবীর সিকদারের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা বাড়ির জানালা গ্রিল ভাঙচুর করে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। দ্রুত লোকজন এগিয়ে আসায় তারা ভেতরে ঢুকতে না পেরে কয়েক জায়গায় পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে তাদের মোটরসাইকেলে চড়েই পালিয়ে যায়। গ্রামবাসী দ্রুত সেই আগুন নিভিয়ে ফেলে। খবর দেওয়া হয় ফরিদপুরের পুলিশকেও। পুলিশ এসে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়ে চলে যায়। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান র্যাব সদস্যরা ও সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। তারাও বিস্তারিত জেনে নেন। এতো কিছুর পরও আমার ভাই ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় মামলা দূরে থাকুক, একটি জিডি করবারও সাহস পায়নি! কেননা, নিকট অতীতে ফরিদপুরে হত্যার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি নূর মোহাম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল, আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট বদিউজ্জামান বাবুল ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতা অলক সেনকে নৃশংসভাবে কোপানো হয়েছে। ওই সব বড় বড় ঘটনাতেও থানা পুলিশ কোনও ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ফরিদপুরে চলমান এমন নির্মম বাস্তবতায় আমার ভাই সুবীর কেন থানায় মামলা কিংবা জিডি করতে যাবে!

গত ১৫মে ফরিদপুর শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডে আমার ছোট বোনের জামাই সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের তপন দেবনাথের বাসায় হানা দেয় একদল যুবক। অধ্যাপক তপন দেবনাথ তখন কলেজে ছিলেন। ওই যুবকেরা আমার বোন দীপ্তি সিকদার ও তার অটিস্টিক সন্তান দীপ্ত দেবনাথ মনময়কে জোর করে বের করে দিয়ে বাসায় তালা লাগিয়ে চলে যায়! গৃহহারা আমার অসহায় বোন ও তার অটিস্টিক সন্তান আশ্রয় নেন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে। সেখানেও তাদের আশ্রয় হয়নি। তাদেরকে ফরিদপুর শহর ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অধ্যাপক তপন দেবনাথ ও তার স্ত্রী-পুত্র শহর থেকে দূরে কানাইপুরে আমার ভাই সুবীর সিকদারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। পড়ন্ত বিকেলে তাদেরকে ফরিদপুর ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়! তারা বাধ্য হয় ফরিদপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে। এখনো তারা ঢাকাতেই রয়েছেন। আমার বোনের পরিবারটি কতো দিনে ফরিদপুরে ফিরতে পারবেন, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই! আশ্চর্যের বিষয়, এমন বর্বর ঘটনা জানার পরও ফরিদপুরের প্রশাসন কিংবা পুলিশ ওই অসহায় অধ্যাপক পরিবারের পাশে দাড়ায়নি! গত ১৮ মে অব্যাহত হুমকির মুখে সপরিবারে ফরিদপুরের কানাইপুরের বাসভবন ছাড়তে বাধ্য হয় আমার দুই ভাই সুবীর সিকদার ও পীযূষ সিকদার। তারাও শুধু কানাইপুরই নয় ফরিদপুরে ত্যাগে বাধ্য হয়।

ওই দিনই আর একদল তরুণ হানা দেয় ফরিদপুরে কানাইপুর বাজারে। তারা হানা দেয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সন্তান আমার স্ত্রী অনিতা সিকদারের তিন ভাই গৌর সাহা, বলাই সাহা ও দিলিপ সাহা ওরফে বন্ধু সাহার তিনটি দোকানে। তারা জোর করেই তাদের তিনটি দোকান বন্ধ করে দেয়! পরে তারা হানা দেয় তাদের বাড়িতে। সেখানে দীর্ঘ সময় আতংক ছড়িয়ে তারা আমার শ্যালক বন্ধু সাহার স্ত্রী ডলি সাহা, সন্তান রিতম সাহা ও ভাগ্নে তাপস সাহাকে জোরজবরদস্তি করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ফরিদপুর শহরের দিকে চলে যায়। এই ঘটনায় আমায় আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে একাত্তরের চেয়েও ভয়ংকর আতঙ্ক নেমে আসে, না জানি ওদের কপালে কী দুর্ভোগ নেমে আসে! পরে আমরা জানতে পারি, তাদেরকে জোর করে ঢাকার বাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। বড় বেদনার সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, ভয়ংকর এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ফরিদপুরের প্রশাসন ও পুলিশ রহস্যজনক কারণ নির্লিপ্ত থাকে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উপরের বর্বর ঘটনা দুটি আমাকে, আমাদেরকে বারবার একাত্তরের ভয়াবহতার কথা মনে করিয়ে দেয়! দুটি ঘটনার সময়েই ওই যুবকেরা বার বার একটি কথাই বলেছে, 'প্রবীর সিকদারকে মন্ত্রী মহোদয়ের বিরুদ্ধে লেখালেখি বন্ধ করতে বলেন। নইলে ফরিদপুরে আপনাদেরকে আরও ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে! লেখা বন্ধ না হলে প্রবীর সিকদারের কোনও আত্মীয় স্বজনকেই ফরিদপুরে স্বস্তিতে থাকতে দেওয়া হবে না'।

ওই দুই বড় বর্বর ঘটনাতেই থেমে থাকেনি ফরিদপুরের লুটেরা দুর্বৃত্ত চক্র। তারা কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬মে ফরিদপুর শহরের প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে তথাকথিত সচেতন হিন্দু সমাজের ব্যানারে একটি মানববন্ধন করিয়েছে। সেই মানববন্ধন থেকে আমার বিচার ও ফাঁসি দাবি করা হয়েছে। ফরিদপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে আমাকে। আমার অপরাধ, আমি নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করি কিংবা করছি ও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের চরিত্র হনন করছি! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি চাইলে আমার সকল লেখা আপনার সমীপে দাখিল করবার সৎসাহস আমার রয়েছে। আপনিই পড়ে সিদ্ধান্ত দিন, আমার কোন লেখায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করেছি, কোন লেখায় আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের চরিত্রহনন করেছি! এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য স্পষ্ট, যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন, তাদের অনিয়ম দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে লেখার অপরাধেই তারা আমার বিরুদ্ধে অবস্থান জাহির করতেই যা ইচ্ছে তাই করছেন! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এবার আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, এই সব ঘটনা কিংবা অপকর্ম করছে কারা? আপনি অভয় দিলে আমি পরিষ্কার করেই বলতে পারি, প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে থেকে যারা ফরিদপুরে নানান অপকর্ম করছেন, তারা সবাই সাবেক একজন মন্ত্রীর অনুগত এবং বিশ্বস্ত সহচর! কান টানলে মাথা আসবেই!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি ধরেই নিলাম, ফরিদপুরের হাইব্রিড লুটেরা দুর্বৃত্তদের অনিয়ম দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে লেখালেখি আমার অপরাধ! তাহলে তো সেই অপরাধের শাস্তি আমি ভোগ করবো! আমার অপরাধের শাস্তি কেন ভোগ করবেন আমার ভাই বোন আত্মীয় স্বজনেরা? আপনার কাছে আমার একটাই আকুতি, আমি অপরাধ করলে শাস্তি দিন শুধু আমাকেই। আর যদি এর অন্যথা হয়, তাহলে গত ৮মে থেকে শুরু করে এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার ভাই বোন আত্মীয় স্বজনদের ওপর যারা বর্বর নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছে কিংবা চালিয়ে যাচ্ছে, তদন্ত সাপেক্ষে তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচার ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করুন। ফরিদপুরের ওই লুটেরা দুর্বৃত্ত চক্র শুধু আমি কিংবা আমার ভাই বোন আত্মীয় স্বজনদের জন্যই হুমকি নয়, ওরা আপনার, আপনার নেতৃত্বের সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্যও হুমকি!

লেখক : সংবাদকর্মী।