স্টাফ রিপোর্টার : সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন পরিচালিত র‌্যাংকিংয়ে এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিলেও সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। তালিকায় নাম না থাকার কারণগুলোও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।

রবিবার (১৯ মে) দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ড. মঈন খান কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন।

জরিপ করার সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞান আদান-প্রদান এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি- এই চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে টাইমস হায়ার এডুকেশন। এতে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চীনের সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠে এসেছে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং হংকং ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির নাম। এই জরিপে চীনের ৭২টি, ভারতের ৪৯টি, তাইওয়ানের ৩২টি, পাকিস্তানের ৯টি এবং হংকংয়ের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আছে। এমনকি নেপাল ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই এই তালিকায়।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মঈন খান বলেন, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে একসময় আমরা গর্ব করতাম, যে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দর্পণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তার নাম এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও নেই। বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে হাজারের মধ্যেও নেই কেন? সেটা আজ জাতির কাছে বড় প্রশ্ন।’

তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকার সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ডিপার্টমেন্টেই কোর্স কারিকুলাম বা সিলেবাসসমূহ উন্নত বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হালনাগাদ করা হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো থেকে ছাপা হওয়া নামি প্রকাশকের পাঠ্যবইয়ের বদলে অখ্যাত ভারতীয় বা অনুন্নত বিভিন্ন দেশের প্রকাশকের পাঠ্যবই বেছে নেয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ মানসম্মত পাঠদানের জন্য অতীব জরুরি একটি বিষয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব আজ চরম আকার ধারণ করেছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে মূল্যায়ন না করে নিছক দলীয় রাজনৈতিক কর্মী অর্থাৎ ছাত্রলীগের কর্মীকে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে ভোটার তৈরির চেষ্টা করা হয়। যাতে শিক্ষক রাজনীতিতে প্রভাব বজায় রাখা সম্ভব হয়।’

দ্রুতগতি সম্পন্ন ইন্টারনেটসহ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত উল্লেখ করে মঈন খান বলেন, ‘নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি হরেক রকম রেফারেন্স বই এবং জার্নালের সম্ভার থাকতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারগুলোতে। ইলেকট্রনিক লাইব্রেরিতে পরিণত হয়েছে উন্নত বিশ্বের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটি এখন পুরনো বইয়ের একটি প্রদর্শনী কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যেখানে জ্ঞানান্বেষণে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা কদাচিৎ পা ফেলে থাকে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে এমন সব দুষ্প্রাপ্য বই ও পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ রয়েছে যা পৃথিবীর অনেক খ্যাতনামা লাইব্রেরিতেও নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ সেগুলোর আদৌ কোনো ব্যবহার আছে কিনা সন্দেহ। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিচে নেমে যাওয়ায় অবাক হবার কী আছে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতি স্কুলের পাঠদান পদ্ধতি থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা মন্তব্য করে মঈন খান বলেন, ‘স্কুলের বাচ্চাদের যেভাবে পড়ানো হয়ে থাকে সে রকমই একমুখী লেকচারভিত্তিক পদ্ধতিই অনুসরণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একমুখী লেকাচার দেয়া ছাড়াও ক্লাসরুমে ইন্টার-অ্যাকটিভ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। গ্রুপ বা ইন্ডিভিজুয়াল অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়, সারপ্রাইজ কুইজ বা টেস্ট নেয়া হয়। গ্রুপ বা ইন্ডিভিজুয়াল প্রেজেন্টেশন নেয়া হয়। মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জামের সহায়তা নিয়ে অডিও বা ভিডিও ক্লিপিংস দেখানো হয়, শিক্ষকের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক সেক্টরে ছাত্রছাত্রীদের ভিজিটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিশেষ করে দেশ-বিদেশের নামিদামি অধ্যাপক ও প্রাসঙ্গিক সেক্টরের সফল পেশাজীবীদের অতিথি শিক্ষক হিসেবে আনা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা করা হয় না।’

বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জ্ঞানভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পরিলক্ষিত হয় না অভিযোগ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম এমন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে স্থাপন করা উচিত, যাদের বৈশ্বিক পর্যায়ের র‌্যাংকিং উল্লেখযোগ্যভাবে উঁচুমানের এবং গবেষণা কার্যক্রমে বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ২৮৩টি এক্সচেঞ্জ চুক্তি রয়েছে দেশ-বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয় বা সংস্থার সঙ্গে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে উঁচুমানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আছে কি না, সে ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয়া প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।’

তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র কাগজে-পত্রে সংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশে সাধারণ মানের ভুরি ভুরি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে নিচু মানের র‌্যাংকিংয়ের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে চূড়ান্ত বিচারে গিয়ে কতটুকু লাভ হবে, তা বিবেচনার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে যে, ধারণাগতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। অতএব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সচেঞ্জ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও উন্নত বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই বেছে নেয়া উচিত।’

ড. মঈন খান বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন ইউরোপ-আমেরিকা-চীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হবার পেছনে তাদের সম্পদ ও সমরাস্ত্র। কথাটি সঠিক নয়। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান আমেরিকা, ইউরোপ ও চীনে। কাজেই একটি জাতির উন্নতির সোপান একমাত্র শিক্ষা।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেই বিবেচনায়, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়াই যথেষ্ট। অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও নকল দিয়ে সরকার এই কাজটিই বাংলাদেশে করছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে।’

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ওবায়দুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপুসহ অন্যরা।

(ওএস/এসপি/মে ১৯, ২০১৯)